Image

৫ বছরেও শেষ হয়নি ভবন নির্মাণ, খোলা আকাশের নিচে চলছে পাঠদান

মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর থেকে: নীলফামারীর সৈয়দপুরের কুমারগাড়ী দাখিল মাদ্রাসার চারতলা ভবনের নির্মাণ কাজ দেড় বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ৫ বছরেও হয়নি।  ঠিকাদারের নানা অজুহাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ শেষ করতে তিন দফা মেয়াদ বাড়ালেও তা শেষ হয়নি। ফলে ভবনের ক্লাশ রুম, শিক্ষকদের অফিস রুমসহ অন্যান্য কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে খোলা মাঠে। কবে নাগাদ এ কাজ শেষ হবে তা বলতে পারছে না কেউ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদরাসা ভবনের নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের জুন মাসে শুরু হয়। আর এটি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার কথা ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। অথচ ১৮ মাসের কাজ ৬০ মাসেও শেষ না করে ভবনের ২৫  শতাংশ কাজ বাকি রেখেই চুক্তি মূল্যের ৮০ শতাংশ বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। গেল বছরের জুলাই - আগস্টে ছাত্র জনতার গণআন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর লাপাত্তা ওই ঠিকাদার। মাদরাসার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ভবন নির্মাণ বিষয়ে একাধিক পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের কাছ থেকে আশ্বাস মিললেও তা কাগজে কলমেই রয়েছে। 

এদিকে শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠেই চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। নির্মাণাধীন ভবনের দুই পাশে শিডিউল করে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। 

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, নির্মাণাধীন ভবন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় কার্যক্রম বন্ধ থাকলে  সেখানে চলে মাদকের আড্ডা ও অসামাজিক কাজ।

মাদ্রাসা ও নীলফামারী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র জানায় , ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই মাদরাসায় বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ২৮৫ জন। পাঠদানের জন্য রয়েছেন ১৩ জন শিক্ষক। কর্মচারী রয়েছেন ৩ জন। 

সুত্রটি জানায়, শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে শ্রেনী সংকট দূর করতে কুমারগাড়ী দাখিল মাদরাসার চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল দরপত্র আহবান করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে 'নির্বাচিত বেসরকারি মাদ্রাসা সমূহের উন্নয়ন' প্রকল্পের আওতায় চার তলা ভবন নির্মাণে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৫ হাজার ৫১৩ টাকা ১৯ পয়সা বরাদ্দ দেওয়া হয়। দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি পান দিনাজপুর জেলা আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মোহাম্মদ শাহ  আলমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ এন্ড জিন্নাত আলী জিন্নাহ (জেভি)।

দরপত্র অনুযায়ী ওই বছরের ১৭ জুন মাদরাসার পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনের ৬ টি শ্রেণিকক্ষ ভেঙ্গে সেখানে ১২ কক্ষ বিশিষ্ট চারতলা ভবনের কাজ শুরু করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এরপর নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ২০২১ সাল থেকে ৩ বছর কাজ বন্ধ রাখে ওই ঠিকাদার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় কাজ সম্পাদনের বিষয়েও তেমন তাগাদা ছিলো না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে পুনরায় কাজ শুরু করলেও ৩ মাসের মাথায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরই মধ্যে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২২ মে) সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চারতলা ওই বহুতল ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে। নির্মাণাধীন ওই ভবনে এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রী। শ্রেণিকক্ষ না থাকায় খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠে চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। নির্মাণাধীন ভবনের দুই পাশে শিডিউল করে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। পুরাতন টিনশেট যে ভবনটি রয়েছে তাও অত্যন্ত জরাজীর্ণ। চালার টিনগুলো ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি এলে সেখানে ক্লাশ নেওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে।

দশম শ্রেণির ছাত্রী লাবনী আক্তার, নবম শ্রেণির ছাত্রী মনি আক্তার ও ৭ম শ্রেণির ছাত্র আমির হামজা জানায়,  তারা এই মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে দেখছে নির্মাণাধীন চারতলা ওই ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে।  শ্রেণিকক্ষ সংকটের  কারণে চরম কষ্টে তাদের পড়াশোনা চলছে। বেশিরভাগ সময় তাদের খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করতে হয়।  শীত, ঝড়-বৃষ্টির কারণে অধিকাংশ সময় তাদের নিয়মিত পড়াশোনা ব্যাহত হয়। তারা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, এই মাদ্রাসার পড়া অবস্থায় মনে হয়না তাদের এ নতুন ভবনে ক্লাস করার সৌভাগ্য হবে।

মাদ্রাসার শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, আমিনুল ইসলাম ও রিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা যেভাবে পাঠদান অব্যাহত রেখেছি, তা একেবারেই অমানবিক। শ্রেণিকক্ষের অভাবে জরাজীর্ণ পুরাতন ভবনের এক রুমে আলাদা দুটি শ্রেনির শিক্ষার্থী বসিয়ে গাদাগাদি করে ক্লাস নেয়া ছাড়াও খোলা আকাশের নিচে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতে হচ্ছে। তাছাড়াও জরাজীর্ণ পুরাতন টিনের চালার ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। 

কুমারগাড়ী দাখিল মাদ্রাসা সুপার মোছা. ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও তারা নির্মাণকাজ শেষ করছে না। তা ছাড়া এ ব্যাপারে আমরা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর নীলফামারীর প্রধান প্রকৌশলী বরাবর কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। এরপরও কাজ শেষ করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ থাকলে সেখানে এলাকার কিছু মাদকসেবী  মাদকের আড্ডা বসায় এছাড়া নানা অসামাজিক কাজ করে।

এ নিয়ে কথা হয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের  নির্বাহী প্রকৌশলী হাজেরুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ভবনটির ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ওই ঠিকাদারকে আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে। এরপর তিন দফা মেয়াদ বাড়ানো হলেও  বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করতে পারেনি। এ বিষয়ে এর আগে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বললে তারা আমদের চলতি বছরের আগামী জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা জানান।  কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগের চেষ্টা করেও খোঁজ মিলছে না ঠিকাদারের। প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘মোবাইল ফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। জুনের মধ্যে কাজ শেষ না হলে চুক্তি বাতিল করে অবশিষ্ট কাজের জন্য আবার দরপত্র দিয়ে কাজটি শেষ করা হবে।