Image

সংবাদপত্রের মান নিয়ে কথা

বছর ত্রিশেক আগের কথা। সংবাদপত্রের মান নিয়ে কথা হচ্ছিল এক ডাক্তারের সাথে। একটি দৈনিকের ঈর্ষণীয় প্রচার সংখ্যার ভিত্তিতে তার বিবেচনায় ওই পত্রিকাটি মানসম্পন্ন। তার কথার সাথে আমার ভিন্নমত ছিল। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম প্রচার সংখ্যা দিয়ে সংবাদপত্রের মান নির্ধারণ করা যায় না। পত্রিকাটি যদি মান নির্ধারণের ছকে না পড়ে তাহলে প্রচার সংখ্যায় তার ব্যবসার প্রসার হতে পারে; এর বাইরে আর কিছুই না।

আমি যেমন তার মতের সাথে একমত ছিলাম না, তিনিও আমার মতের সাথে একমত হলেন না। হতেই পারে। আমি যা ভাববো তিনি তাই ভাববেন তা নাও হতে পারে। তার মূল্যায়নটা এমন যে, মানসম্পন্ন না হলে ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের হাতে হাতে ঘোরে কেন পত্রিকাটি। অকাট্য যুক্তি তার।

আমি তার প্রতি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। বললাম, ধরুন একটি বইয়ের দোকান অর্থাৎ লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, সেক্সপিয়র, ওমর খৈয়ামসহ পৃথিবীর খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকদের পর্যাপ্ত বই আছে। পাশাপাশি পর্নপত্রিকাও আছে। এর মধ্যে কোনগুলোর কাটতি বেশি হবে?

তিনি অকপটে স্বীকার করলেন পর্নপত্রিকার কাটতি বেশি হবে।

আমি আবারো প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, তাহলে কি পর্নপত্রিকাগুলোকে মান সম্পন্ন সাহিত্যে ভরপুর বলবেন? এরপর তিনি যেমন আর কথা বাড়ালেন না, তেমনি আমিও কিছু বললাম না।

সাংবাদিকতার পাঠশালায় আমরা শিখেছি, সংবাদপত্র সুশীল পাঠক বা সুশীল সমাজ গড়বে। এজন্য যা প্রয়োজন সংবাদপত্র তাই করবে। ভালোকে গুরুত্ব দিয়ে মন্দকে বয়কট করবে। এখানে চটকদারির কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু হালে এসে দেখা যাচ্ছে ওই নীতি কেউ অনুসরণ করছেন না। এখন পাঠকরা সংবাদপত্র গড়ছেন। তারা যেভাবে চাচ্ছেন সংবাদপত্র সেভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে। সংবাদপত্রের ডেস্কে একটি কথা চালু আছে। তাহলো, ‘খাবে ভালো’। অর্থাৎ ছাপার উপযোগী নয়, কিন্তু ছাপা হলে পাঠক লুফে নেবে। পত্রিকার কাটতি বাড়বে। যে সব পত্রিকা পাঠকের এই চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে তারা প্রচারে তুঙ্গে।

প্রসঙ্গক্রমে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, বর্তমানে যে সব পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ভালো আমি তাদেরকে ইঙ্গিত করছিনে। সবগুলোকে এক দাঁড়িতে মাপা যাবে না।

একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে একদিনে দুটি খবর আপ হয়। এর একটি হলো পদ্মাসেতুতে মাথা লাগবে এ গুজবে এক নিরীহ নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা। ওই নারীর ছোট্ট মেয়েটি বার বার তার স্বজনদের কাছে জানতে চাচ্ছে, আম্মু কই? স্বজনরা তাকে বোঝাচ্ছে, তোমার জন্য খেলনা আনতে গেছে। এক্ষুনি এসে যাবে। অন্য খবরটি হলো ভারতের এক হাসপাতালে এক নারী সন্তান প্রসব করলে পাঁচ পুরুষ হাজির হয়ে তারা প্রত্যেকে দাবি করে সন্তানটি তার ঔরসজাত। প্রথম সংবাদটিতে আমাদের দেশের অবক্ষয়ের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে একটি মানবিক চিত্রও। আর দ্বিতীয় খবরটিতে একটি দুর্গন্ধময় সমাজের নোংরা চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো শেষের খবরটিতে রিচ-লাইক পড়ে অগণিত। আর প্রথম খবরটি কেউ পড়েইনি। এমন ঘটনা শুধু একটি নয়, প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। যার সার কথা হলো পাঠক ভালো খাচ্ছে কি, আর আমরা কি পরিবেশন করছি দেখুন এবং ভাবুন।

একটি কথা সবাই বলে থাকে, সংবাদপত্রে বিভৎস ছবি ছাপানো উচিত না। এটা সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যেও পড়ে। কিন্তু অনলাইন সংবাদপত্রগুলো এই ছবি প্রকাশ করে রিচ-লাইক পাচ্ছে বেশি। আর তাতে তারা এসব খবর প্রকাশে উৎসাহী হচ্ছেন।

বহুল প্রচলিত অনেক পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে বানানের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই, তা সে পুরনো বানান রীতি হোক হোক আর সংশোধিত বানানরীতি হোক। বাঙালি জাতি। এ ঐতিহাসিক সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে এক সাগর রক্ত ঢালতে হয়েছে। আমরা যারা সংবাদপত্রে কাজ করি তারা প্রতিদিন ভাষা চর্চা করছি। অথচ এ শব্দটা আমরা শুদ্ধ করে লিখতে পারছিনে। কেউ লিখছি বাঙ্গালি, কেউ লিখছি বাঙ্গালী, কেউ লিখছি বাঙালী ইত্যাদি। এ শুধু একটার উল্লেখ করলাম। এমনিভাবে শ’ শ’ বানান ভুল লিখেও প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে অনেক পত্রিকা। এই যখন অবস্থা তখন কি বলা যাবে ভুলের মালা গলায় নিয়েও যে পত্রিকা প্রচারে শীর্ষে সে পত্রিকা মান সম্পন্ন? মূল কথা হলো সব পাঠক কিন্তু বোদ্ধা পাঠক নয়। মান নির্ণয় করার ক্ষমতা সবার নেই।

অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার কথা অনেকে জানেন। সত্যি কথা বলতে কি টেন্ডার নোটিশ দেখার জন্য ঠিকাদারদের বাইরে পাঠক খুব একটা ছিল না। এই পত্রিকাটি কিন্তু একটি মানসম্পন্ন পত্রিকা ছিল। কেউ পত্রিকাটিকে মানের দিক থেকে খাটো করে মন্তব্য করতে সাহস দেখাতে পারেননি।

সংবাদপত্রের সামনে পথ দুটি। একটি আদর্শের, অন্যটি ব্যবসার। আদর্শের প্রশ্নে যেটি দৃঢ় থাকবে সেটির পথচলায় টানাপোড়েন থাকতে পারে। তবে সেটির আয়ু দীর্ঘ। আর ব্যবসায়ীক স্বার্থের দিকে যেটির নজর সেটি ধুমকেতুর মতো। আকষ্মিকভাবে আবির্ভুত হয়ে আবার আকষ্মিকভাবে হারিয়েও যেতে পারে।

একবার বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলো ‘ভারতীয় শুকুরে বাংলাদেশের ফসল নষ্ট করছে’।

এই খবরটিকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হবে? শুকরের কি কোনো সীমান্ত আছে? বন্য প্রাণি যখন যেখানে পরিবেশ ভালো মনে করে সেখানে থাকে। আর একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হলো ‘মানুষের কথা (কল্পিত নাম) পত্রিকার গাড়ি থেকে ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার’। যারা খবরটি প্রকাশ করেছেন তাদের বোঝা দরকার ছিল পত্রিকাটির কোনো গাড়ি নেই। ক্যারিং কনট্রাক্টর পত্রিকা বহন করে দেয়। যদি ওই গাড়ি থেকে ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার হয়ও তাহলে তার দায়-দায়িত্ব ক্যারিং কনট্রাক্টরের। পত্রিকার তাতে যায় আসে না। এই বহুল প্রচারিত পত্রিকা দুটিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখবো?

মানবকণ্ঠ/আরবি