Image

ব্যাংক ঋণের ছয়-নয় আর কত?

ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরার আলামত এখন প্রায় তলানির পর্যায়ে। খেলাপি ঋণে মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটি তেমন সমস্যা নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কারণ হিসেবে বলেছেন, প্রতিবেশি ভারতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশের ওপর। আমাদের দেশেও তাই আছে। কিন্তু ভারতের বাকি তথ্য তিনি বলেননি। ভারতে যে ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হওয়াসহ অন্যান্য কারণে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে এখন ৪.৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে সে কথা কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি। অবশ্য আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের এই খারাপ অবস্থাকে এভাবে চাপা দিতে গিয়ে এমন ধামা খোঁজা তার জন্য নতুন কিছু নয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে তিনিই আবার বিশ্বসেরা অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক মাসিক ম্যাগাজিন ‘দ্য ব্যাংকার’ তাকে এই খেতাব দিয়েছে। এদিক থেকে অবশ্যই দেশের গর্ব অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল। কারণ বাংলাদেশের আর কোনো অর্থমন্ত্রী এমন অ্যাওয়ার্ড কখনো পাননি। এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ব্যাংক ঋণের সুদের হারের নয়-ছয় বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী কঠোর অবস্থানে। আগামী এপ্রিল মাস থেকেই তা বাস্তবায়ন করে ছাড়বেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।

 

 

 

 

 

 


মজার ব্যাপার হচ্ছে অর্থমন্ত্রী যেদিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি এ ঘোষণা দেন পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী সেদিন থেকেই ব্যাংক খাতে শিল্প ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আবার এপ্রিল পর্যন্ত চলে গেল কেন? এমন প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী কিন্তু আগের নয়-ছয় জবাবই দিয়েছেন। আর ব্যাখ্যায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দোহাই। বলেছেন, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদ ছয় শতাংশ বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু প্রথম দিকে এটি আমরা ফেইজ ওয়াইজ বাস্তবায়ন করব বলে ধারণ ছিল। কিন্তু পরে দেখলাম যে, শুধু আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করি তাহলে অনেক ইন্ডাস্ট্রি বাদ পড়ে যাবে, অনেক খাত বাদ পড়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন সফলতা পেতে চাইলে সব ঋণগ্রহীতাকে এ সুবিধা দাও। সে জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে।

শুরু থেকে অর্থমন্ত্রীর যাবতীয় কথামালা চলে আসছে এভাবেই। ব্যাংকগুলো কেন কথা শুনছে না? তারা কি সরকারের চেয়ে বেশি বড়- এমন আক্রমণাত্মক ধমকিও বাদ দেননি। কোনটা হুমকি, কোনটা জবাব, অজুহাত বা ব্যাখ্যা কিছুই বলার অবস্থা নেই। দেশের অর্থ সেক্টরের আরেক জায়গা শেয়ারবাজার নিয়েও তার কথাবার্তাও প্রায় এমনই। তার ভাষ্যমতে, অন্যান্য দেশ বা বিদেশে শেয়ারবাজার সূচক এক হাজার থেকে শূন্যতে আসলে এসইসি চেয়ারম্যানকে গালি দেওয়া, মারতে যাওয়া, রাস্তায় গাড়িও ভাঙ্গা- এটা স্বাভাবিক। পরক্ষণেই বলে দিলেন, পুঁজিবাজারের মূল ভিত্তি হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে পুঁজিবাজার তত শক্তিশালী হতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা ঘটে না, কেন হয় না সময় আসলে হয়তো বলা যাবে, কেউ ইচ্ছাকৃত করে কিনা এটা তো একটা রিফ্লেকশন।

ফিরে আসি ব্যাংকিং খাতেই। সুদহার না কমলেও খেলাপি ঋণ কিন্তু বাড়ছেই এর মধ্যে গত ৯ মাসেই বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ জন্য এখন সব দোষ চাপানো হয়েছে ঋণের উচ্চ সুদহারের ওপর। এ নিয়ে অবশ্য ব্যাংক এবং খেলাপি দুই পক্ষের কড়া যুক্তিও রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক অঙ্কের সুদের হারের কথা এক-দেড় বছর ধরে শুনতে শুনতে তিতা হয়ে গেছে তাদের কাছে। একেকবার একেক কথায় তারা আর মজতে চান না। ভ্যাট ও ব্যাংকের সুদ দিতে দিতেই কাহিল হয়ে গেছে বলে দাবি তাদের। কথা প্রসঙ্গে এক ব্যবসায়ী সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বইকেনা’ গল্পের একটি উদ্ধৃতির কথা মনে করিয়ে দেন। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে, ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলেই বই সস্তা করা যায় না।’ আত্মপক্ষে কথা আছে ব্যাংকার ও ব্যাংক মালিকদেরও। তাদের যুক্তি- খেলাপি ঋণ নতুন রোগ নয়। আর সুদহার সব সময় বাড়ে-কমে। ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল যখন সহজলভ্য হয়, তখন ঠিকই সুদহার কমে যায়। যেমন সর্বশেষ ২০১৭ সালে সুদহার এক অঙ্কে নেমে এসেছিল।

আবার এ কথাও তো সত্য, ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ব্যাংকমালিকরা গত দেড় বছরে সরকারের কাছ থেকে ঠিকই নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার ১ শতাংশ কমানো, রেপোর সুদহার ও করপোরেট কর কমানো ইত্যাদি। মাঝে আবার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক এবং টানা ৩ বছরের পরিবর্তে টানা ৯ বছর বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে থাকার বিধানও করে দেয় সরকার। এত সুবিধা পেয়েও সুদহার কমানোর পদক্ষেপে যেতে তাদের যত অনীহা। এতে মনোক্ষুণœ হলেও পারস্পরিক স্বার্থে ঋণ পেতে শেষ পর্যন্ত সমস্যা হয় না ব্যবসায়ীদের। তাদের অনেকে আবার বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকও। অর্থাৎ সবার স্বার্থ এক জায়গায়ই। অর্থমন্ত্রীও এই সম্প্রদায়ের বাইরে নন। পরিণতিতে যা হবার সেটাই হচ্ছে। খেলাপি ঋণ উদ্ধার না করায় নতুনরাও ঋণ খেলাপিতে পড়তে উৎসাহিত হচ্ছেন।

এর আগে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে পদ্ধতিগত কিছু সংস্কার এনেছেন। সমালোচকরা সেটাকে সংস্কার না বলে কুসংস্কার নামে তাচ্ছিল্য করে অভ্যস্ত। আসলে গোটা ব্যাংকিং খাত যে অবস্থায় গেছে সেখানে অর্থমন্ত্রীসহ প্রায় সবারই ছয়-নয় কথা, মন্তব্য, হুমকি-ধমকির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া অনেকটা অনিবার্য হয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীর প্রথম সংস্কার ছিল, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করে নমনীয় করা। হয়তো আশা করেছিলেন এতে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। কিন্তু বাস্তব বড় করুণ। সংস্কার প্রস্তাব জারি হওয়ার পর থেকে খেলাপি ঋণ না কমে বরং আরো বেড়েছে। নতুন খেলাপি জন্ম নিয়েছে বহু।

এরপর আসে সংস্কারের দ্বিতীয় পর্ব। প্রস্তাবটি ছিল ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে সব খেলাপি ঋণ হালনাগাদ করা যাবে। অর্থাৎ ১৯৭২ সাল থেকে এ যাতৎকালের সকল খেলাপি ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে হালনাগাদ করে ফেলা যাবে। এটি আর মন্দ ঋণ থাকবে না। শুধু তাই নয়, হালনাগাদ করার পর ঋণের সুদের হারও কমিয়ে মাত্র ৯ শতাংশ ধার্য করা হয়। আগে যেখানে ১২-১৪ শতাংশ সুদ ছিল সেটাকে কমিয়ে ৯ শতাংশ করা হবে এবং এটি ভালো ঋণ হিসেবে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত থাকবে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার ইস্যু করলেও প্রচলন করতে পারেনি, কারণ বিষয়টি জনস্বার্থবিরোধী বলে মনে হওয়ায় এটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাইকোর্টে। আর হাইকোর্টে দীর্ঘদিন ধরে এটি নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলেছে। আইনের দৃষ্টিতে বলা হয়, এ ধরনের সংস্কার করতে হলে তো বাংলাদেশ ব্যাংক করতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের নিয়মকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সেজন্য তারা বলেছিলেন ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণটি হালনাগাদ হবে, তবে ঋণগ্রহীতারা নতুন ঋণ পাবে না। যদি তারা পেতে চায় অন্তত ১৫ শতাংশ টাকা তাদের আরও জমা দিতে হবে। সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থায়ী সার্কুলারের মতো ছিল। ফলে ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে হালনাগাদ করে নতুন ঋণ নেয়ার যে প্রচেষ্টা ছিল তাতে কিছুটা ভাটা পড়ল। এই চক্করে অনেক ভালো ঋণগ্রহীতাও মন্দ ঋণগ্রহীতার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। এই ধারার কারণ ও নেপথ্য কম বেশি সবারই জানা।

উল্লেখ্য স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা তাজউদ্দীন আহমদ, ড. এআর মল্লিক, সাইফুর রহমান, এসএএমএস কিবরিয়া, এমএ মুহিতদের সবাই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু একজনও ব্যবসায়ী ছিলেন না। বিশ্বসেরার খেতাবও তাদের কারো ভাগ্যে জোটেনি কখনও। বাংলাদেশ এবারই প্রথম একজন বড় ব্যবসায়ীকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে। তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন দায়িত্ব পেয়েই। বলেছেন, ‘কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতাই জেলে যাবে না। এমন ঘোষণায় মুগ্ধ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ভেতরে ভেতরে খুশি ব্যাংকের মালিক-উদ্যোক্তা মিলিয়ে সকল ব্যবসায়ী মহলই। সব মিলিয়ে যাহা নয়, তাহাই ছয় আর যাহাই ছয়, তাহাই নয়। আর এখন ব্যাংকিং সেক্টরের পরবর্তী তৎপরতা দেখার অপেক্ষা নতুন বছর ২০২০ সাল।

লেখক : রিন্টু আনোয়ার - সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি