Image

চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রতারণা মডেল কি দায়মুক্ত?

টেলিভিশনের পর্দা, পত্রিকার পাতা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায়, পছন্দের তারকা প্রশংসা করছেন একেকটি পণ্যের। এসব পণ্য ‘তারা নিজেরা ব্যবহার করেন; বলে প্রচার করেন। সবচেয়ে সেরা হিসেবেও চিহ্নিত করেন পণ্যগুলোকে।’ এসব বিজ্ঞাপন দেখে ভক্ত অবিশ্বাস করে থাকতে পারেন না।

এতবড় তারকা নিশ্চয় মিথ্যে বলছেন না; ভেবে পণ্যটি সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রাহক। যে কোম্পানি যত জনপ্রিয় তারকাকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করাতে পারে তাদের পণ্যের চাহিদা তত বাড়তে থাকে। হয়তো এজন্যই পণ্যের গুণগত মানের চেয়ে বিজ্ঞাপনী কৌশলের দিকে বেশি মনোযোগ কিছু কিছু কোম্পানির।

আমাদের দেশের অধিকাংশ বিজ্ঞাপনেই নীতিমালা ঠিকঠাক মানা হয় না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিধি-বিধানের সংকলনের অন্তর্গত বিজ্ঞাপন নীতিমালায় (২.১৫) উল্লেখ রয়েছে (১৬ অনুচ্ছেদ)- বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত পণ্য বা তার কাঁচামাল সম্পর্কিত এমন কোনো গুণের কথা দাবি করা যাবে না, যা আদতে প্রমাণ করা অসম্ভব। এতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হয়। অথচ অধিকাংশ কোম্পানিই তাদের পণ্য প্রচারের ক্ষেত্রে বাড়িয়ে অসংখ্য গুণের কথা প্রচার করেন।

আবার ক’দিন বাদেই গুণগত মান ঠিক না থাকার কারণে সেসব প্রতিষ্ঠানকে দণ্ড ভোগ করতেও দেখা যায়। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর ১০ কোম্পানির পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। বিএসটিআই’র পরিচালক প্রকৌশলী সাজ্জাদুল বারীর স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ১০ কোম্পানির পণ্য বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ নিষিদ্ধ এবং লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।’

কয়েক মাস আগে কয়েক ধাপে শতাধিক কোম্পানির পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেই তালিকায় দেশের নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যই বেশি ছিল। প্রাণ ডেইরির প্রাণ প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের ঘি, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের রাঁধুনী ব্র্যান্ডের ধনিয়া গুঁড়া ও জিরার গুঁড়া, হাসেম ফুডসের কুলসন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, এসএ সল্টের মুসকান ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ, চট্টগ্রামের যমুনা কেমিক্যাল ওয়ার্কসের এ-৭ ব্র্যান্ডের ঘি, চট্টগ্রামের কুইন কাউ ফুড প্রোডাক্টসের গ্রিন মাউন্টেন ব্র্যান্ডের বাটার অয়েল, চট্টগ্রামের কনফিডেন্স সল্টের কনফিডেন্স ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ, ঝালকাঠির জেকে ফুড প্রোডাক্টের মদিনা ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, চাঁদপুরের বিসমিল্লাহ সল্ট ফ্যাক্টরির উট ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ এবং চাঁদপুরের জনতা সল্ট মিলসের নজরুল ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ, তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেল, জিবি ব্র্যান্ডের সরিষার তেল, পুষ্টির সরিষার তেল, রূপচান্দার সরিষার তেল, সান ব্র্যান্ডের চিপস, আরা ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফি ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ণ ডিউ ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকানের ন্যাচারাল মিনারেল ওয়টার, আর আর ডিউ ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, দিঘী ব্র্যান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রাণের লাচ্ছা সেমাই, ডুডলি ব্র্যান্ডের নুডলস, টেস্টি তানি তাসকিয়া ব্র্যান্ডের সফট ড্রিংক পাউডার, প্রিয়া সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশ ব্র্যান্ডের হলুদের গুড়া, প্রাণের হলুদের গুঁড়া, ফ্রেস ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া, এসিআই পিওর ব্র্যান্ডের ধনিয়া গুঁড়া, ড্যানিস ব্র্যান্ডের কারী পাউডার, মধুবনের লাচ্ছা সেমাইয়ের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো এই তালিকায় রয়েছে। এসব পণ্যের বিজ্ঞাপনে আবার বড় বড় তারকাদের দেখেছি।

নামকরা সব তারকারা নানা ভঙিতে ওইসব পণ্যের গুণগান করেছেন। সেগুলো দেখে বছরের পর বছর বিশ্বাস করে কিনেছেন সাধারণ ভোক্তারা। ঠকেছেন প্রতিনিয়ত। ভিজ্যুয়ালের পাশাপাশি প্রিন্ট মাধ্যমেও প্রতারণতা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। নামকরা বিশ্বাসযোগ্য পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ সহজে অবিশ্বাস করতে পারে না। ডেসটিনি, যুবক এবং এ ধরনের আরো কিছু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের কারণে যারা সর্বস্বান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই খবরের কাগজে প্রকাশিত এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, প্রসপেক্টাস, পরিচালনা পর্ষদের বিশিষ্ট নাগরিকদের ছবি, সেই সঙ্গে লোভনীয় মুনাফা দেখেই এগিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে- দু’দিন আগে প্রিয় তারকার মুখে যে পণ্যটির এত প্রশংসা শোনা গেল সেই পণ্যটি-ই যখন হাইকোর্ট থেকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন পছন্দের তাকার প্রতি বিশ্বাসটাই বা কতটুকু টেকে? কিংবা যে তারকা তার খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে এমন বিভ্রান্তিমূলক একটি তথ্য প্রকাশ করলেন তার কি কোনো দায় নেই? তাছাড়া এই ভোক্তা তালিকায় কে নেই? সরকারি আমলা থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ হওয়া কোম্পানির কমকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত সবাই তো দিন শেষে ভোক্তা। যে তারকা তার খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু টাকার জন্য বছরের পর বছর এসব মানহীন পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করলেন তারা কি এসব খাবার থেকে মুক্ত ছিলেন? হয়তো ছিলেন।

বেশি দামে বিদেশি কোনো নামি ব্র্যান্ডের পণ্য দিয়ে হয়তো নিজেদের চাহিদা মিটিয়েছেন। কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজন; সবাই কি ওই মানহীন পণ্য থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন? প্রতারণতার শিকার কোনো ভোক্তা যদি ওই মডেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেন তাহলে কি তা অন্যায় হবে? কয়েকদিন আগে ভারতের আদালতে এমন একটি ঘটনার রায় হয়েছে। ভারতের বিহার রাজ্যের মুজাফফরপুর শহরের একজন আইনজীবী অভিনব আগরওয়াল টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনে দেখলেন বলিউডের খ্যাতনামা অভিনেতা গোবিন্দ ও জ্যাকি শ্রফ যন্ত্রণানাশক একটি তেলের বিবরণ দিচ্ছেন। ১৫ দিন এ তেল মালিশ করলে যন্ত্রণার উপশম ঘটবে, এ গ্যারান্টি মডেলরা দিচ্ছেন।

বিফলে পূর্ণ মূল্য ফেরত দেয়া হবে। মালিশ করার এ তেলের দাম ভারতীয় ৩ হাজার ৬০০ রুপি; সংবাদপত্রেও একই বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। গোবিন্দ ও জ্যাকি শ্রফের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা এ তেল নিয়ে মিথ্যা কথা বলবেন না, ধোঁকা দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। অভিনব আগরওয়াল বিজ্ঞাপন দেখে পণ্যের ওপর আস্থাশীল হয়ে মধ্য প্রদেশের একটি কোম্পানিতে অর্থ পাঠিয়ে তার বাবা ব্রিজভ‚ষণ আগরওয়ালের জন্য মালিশের তেল কিনলেন এবং কোম্পানির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তার বাবা এ তেল ব্যবহার করলেন। কিন্তু তার যন্ত্রণার কোনো উপশম না হওয়ায় তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ক্রয়মূল্য কোম্পানির কাছে ফেরত চাইলেন। কোম্পানি ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করল এবং অভিনব আগরওয়ালকে ঘোরাতে লাগল।

এরপর তিনি মামলা করলেন। কনজিউমার কোর্ট দীর্ঘ শুনানি ও যুক্তিতর্কের পর পণ্যের মডেল গোবিন্দ ও জ্যাকি শ্রফ, টেলিমার্ট শপিং নেটওয়ার্ক এবং ম্যাক্স কমিউনিকেশনকে ২০ হাজার রুপি জরিমানা করেছে, এ অর্থ ভিকটিমকে প্রদান করা হবে এবং বার্ষিক শতকরা ৯ ভাগ সুদসহ মূল ৩ হাজার ৬০০ রুপি এবং ক্রেতার মামলার খরচ কোম্পানি প্রদান করবে। এ ঘটনা থেকে আমাদের দেশের মডেলরা সচেতন হতে পারেন। যে কোনো পণ্যের প্রচারে হুট করেই নিজেকে সম্পৃক্ত করার আগে নিশ্চয় চিন্তা করবেন। পণ্য সম্পর্কে সম্ভবমতো খোঁজ নেবেন। বিজ্ঞাপন নীতিমালা অনুসরণ করবেন।

লেখক: রনি রেজা - কথাশিল্পী ও সাংবাদিক

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি