Image

একটি জঘন্য অপরাধ ও সমাজের দায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী রোববার সন্ধ্যায় শেওড়ায় তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার সময় কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পরপরই তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায় রাতে। রাত পৌনে ১টার দিকে ওই শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই বিক্ষোভ শুরু হয় ক্যাম্পাসে। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিচার দাবিতে রাতে দফায় দফায় মিছিল-সমাবেশ করে বিভিন্ন সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র মো. সিফাতুল ইসলাম ভোর ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশনে বসেন।

সোমবার বেলা ১০টার দিকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হতে শুরু করলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস আবার একটি ধর্ষণের ঘটনা দেখল জাতি। প্রতিবার আমরা কিছুদিন মাতম করি সামাজিক মিডিয়ায় আলোড়ন তুলি তারপর আবার সব সুনসান। যে ব্যাপারটা আমাদের সামাজিক দুর্ভাবনা আর প্রতিবাদের সেটা মাথায় রেখে বাড়িতে কন্যা সন্তান নিয়ে  আমরা পাশ ফিরে আরামে ঘুমাতে শিখে গেছি। এটা ভয়াবহ। মৃত্যু যেখানে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সেখানে ধর্ষণ তো কোনো ছাড়। সমাজে, দেশে মানুষ এত অস্থির আর এত বেপরোয়া কিছুতেই তাদের মনোযোগ নাই খুব একটা। তারা কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে দিন চালাতে ব্যস্ত। যে সব ঘটনা চোখের সামনে আসে বা ধরা পড়ে যায় সেগুলো নিয়েই মাতামাতি করি আমরা। এর বাইরে কত শত ঘটনা, কত রেপ কেস ধামাচাপা পড়ে যায় খবর রাখে না কেউ।

সবচেয়ে ভয়াবহ হলো পারিবারিকভাবে নির্যাতন। দেশে ধর্ম-অধর্ম নিয়ে যত কথা আর প্রচার চলুক না কেন বাস্তবে আমাদের কন্যারা বাড়িঘরে নিজের মানুষদের কাছেই ধর্ষণের ঘৃণ্য আস্বাদ পায়। এখন সামাজিক মিডিয়ার যুগে আরেক ধরনের ধর্ষণ চলছে খুব। গোপন বাক্সে বা নানাভাবে প্ররোচিত করে এসব করা হয়। এর মূলে যাই না আমরা। মুক্ত সমাজ, মুক্ত মিডিয়া আর হঠাৎ খুলে যাওয়া বন্ধ জগৎ যে এক বিষয় নয়, সেটাও বোঝানো হয়নি। বুঝতে পারে না তারুণ্য, জানে না, বোঝে না মাঝবয়সী কিংবা বয়সী মানুষেরা। আর এর ফাঁকে বেড়ে চলেছে আরেক ধরনের বিকৃতি।

বলাবাহুল্য এর চূড়ান্ত আর অসংযত পরিণতির নাম ধর্ষণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর অবসান বা বন্ধে আমাদের দেশ বা সমাজে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়? স্বভাবসুলভ বা প্রচলিত নিয়মে কিছু ঘটলেই আমরা দায় চাপাই সরকারের কাঁধে। অস্বীকার করি না, এর যৌক্তিক কারণ আছে। কম-বেশি সব দেশেই এমন অপরাধ সংঘটিত হয়। উন্নত বা সভ্য সমাজ নামে পরিচিত দেশগুলোতেও হয় কিন্তু আমাদের দেশের মতো ঢালাওভাবে সরকারকে দোষারোপ করার নিয়ম নেই সেখানে। কারণ আইন ও বিচার বিভাগ আমাদের দেশের মতো প্রশ্নবিদ্ধ না। আমাদের দেশে এটা কত ব্যাপক আর ভয়াবহ সেটা সবাই জানেন বলেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ রাগে ফেটে পড়েন। যে ধর্ষণের ঘটনা দিয়ে লেখার শুরু, সে বিষয়ে এমপি রাশেদ খান মেনন ইতোমধ্যে তার মতামত দিয়েছেন।

তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, তথ্য প্রমাণ লোপাটসহ কারো কারো প্রতি অহেতুক দয়ার কারণে এর বিচার পাওয়া যায় না। তাই এ ঘটনার সাবধানতার কথা বলেছেন মেনন ভাই কিন্তু এই স্বীকারোক্তি সমাধান দেবে না। তিনি নিজে মন্ত্রী ছিলেন। এখনো সরকারের সঙ্গে বাঁধা জোটের নেতা। কেন তিনি এ বিষয়ে সরকারপ্রধানকে কিছু বলেন না? কেন এসব নিয়ে তারা রাস্তায় নামেন না? কেবল বিবৃতি আর ভাষণ দেয়াই কি নেতাদের কাজ? রাজনীতি ভয়ানকভাবে ব্যর্থ, এসব ঘটনার মোকাবিলায় আমরা এরশাদ আমলে যৌবন পার করা মানুষ। সব দেখেছি কীভাবে আইন ও বিচার হাতের তালুতে থাকে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ কোনো আমলেই তার ব্যত্যয় ঘটেনি বরং যতদিন যায় তত এসব ঘটনা নয়া বেগ আর নয়া টেকনিকে ফিরে আসে। মাঝে মধ্যে সমাজকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে তুমি আমার কচু করতে পারবে।

এবার তো ঢাকার জনবহুল এলাকা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হলো। কে না জানে চাইলে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনী অপরাধীর ঠিকানা বের করতে লাগবে কয়েক মিনিট কিন্তু লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আর বেড়াজালে ঘটনা চাপা পড়ে থাকবে ফাইলের নিচে। অনুসন্ধান আর তথ্য জোগাড় করতে করতেই কেটে যাবে সময়। তারপর মানুষ ভুলে গেলে অপরাধীও আবার স্বাধীন হয়ে খুঁজে নেবে নতুন শিকার। উল্লেখ্য ধর্ষক ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে। এর কী শাস্তি হয় এখন তা দেখার অপেক্ষা।

ধর্ষণের মনোজাগতিক ব্যাখ্যা বলে এর পেছনে কিছু ইন্ধনও থাকে। মূর্খ কিছু মানুষ মনে করে, এই ইন্ধন থাকে শরীরে বা পোশাকে বা সাজসজ্জায়। মূলত এর বসবাস অপরাধীর বিকৃত মনে। মানসিকভাবে অসুস্থ বলে এদের মনে স্বাভাবিকতা নেই। এদের মগজে কিলবিল করে যৌনতার ভয়াবহ রোগ। ভুলে যায় কোনটা সম্পর্ক আর কোনটা ধর্ষণ। এ কথাও জানা উচিত, আমাদের সমাজে বিবাহিত নারীদের অনেকে তাদের স্বামীর কাছেও এমন অনাচারের শিকার হয়। এই যে অস্বচ্ছ ধারণা আর নিজেকে না জানা সভ্যতা মানবিকতা বা সাধারণ নিয়ম না বোঝা এই অসুস্থতার কারণে এরা পোশাক তো বটেই সামান্য কারণেও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর যার সবর্শেষ পরিণাম ধর্ষণ।

একজন ধর্ষক তাই কোনোভাবেই সুস্থ মানুষ না। ফলে অসুস্থতার পরিমাণ আর মাপকাঠি বিচার করে, হয় তাকে জেলে ঢোকাতে হবে নয়তো সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যাতে কেউ এসব কাজে অগ্রসর হওয়ার আগে একশ’বার ভাবে কিন্তু তা কি হয়? হয় না বলেই একেকবার ধর্ষণের পর আমরা সবাই মাতামাতি করি, তারপর যথা পূর্বং তথা পরং।

সামাজিক মিডিয়া থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ-সবকিছুতে এর বিরুদ্ধে সচেতনতার দরকার। পরিবারে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মা-বাবার যে সময় ব্যয় করা দরকার সে সময় কেড়ে নিয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। ঘরে-বাইরে মোবাইল ল্যাপটপ বা নানাভাবে ব্যস্ত মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা একটি রোগ। যার যার গোপনীয়তা বন্ধনকে যেমন শিথিল করছে তেমনি সবাই মিলে কোনো বিষয়ে আলোচনা বা সঠিক একটা সিদ্ধান্তে আসাও হয়ে উঠছে অসম্ভব। আমাদের যৌবনে মা-বাবারাই ছিলেন প্রাচীর। দেয়াল ছিল শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো। ছাত্র, মাস্টার সহপাঠীরা ছিল অভিভাবক ও বন্ধু। সে সব সম্পর্ক ভেঙে চুরমার আর এই ভাঙা কাঁচেই পা কাটছে আমাদের।

শেষ কথা এই ধর্ষণ সমাজ সংসার সমাজ ও সভ্যতার জন্য ভয়াবহ। একটি দেশ ও সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া আর জীবনকে অপমান করার ঘৃণ্যতম কাজ। সবাই মিলে একে রুখতে হয়। মনে রাখা দরকার, কারো বোন, কন্যা বা আত্মীয়া নিরাপদ না। তবেই ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব বা কমিয়ে আনা সম্ভব। যে পরিমাণ লেখাপড়া ও বোধ থাকলে মানুষ তা করে না, সেটা যেমন নাই তেমনি জানা মানুষেরাও এই অপরাধে দোষী। আমার বিশ্বাস, আইনের কঠোরতা, সঠিক শাস্তি বিধান করা আর নৈতিকতা বাড়ার মতো কাজগুলো সামনে আনলেও সমস্যা সহজ হয়ে আসে।

ধর্ষণকে ঘৃণা করুন, ধর্ষককে প্রতিহত করুন এর শিকার যে বা যারা তাদের বাঁচতে দিন।

লেখক- অজয় দাশগুপ্ত : সিডনি প্রবাসী। 

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি