Image

বিটিভি প্রজন্ম!

ইদানীং আমাদের দেশে প্রজন্ম শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে নানা ফর্মে। স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম, ’৭৫ প্রজন্ম , ’৯০ প্রজন্ম ইত্যাদি। প্রজন্মের ভালো মন্দ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাও চলছে।

আমাদের অনেকের অলক্ষ্যে আরো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল। যে প্রজন্মকে আমি বলছি বিটিভি প্রজন্ম । যাদের বয়স এখন ৩০ বছরের ওপরে আর ৫৫ বছরের নিচে তারাই এ প্রজন্মের  সার্থক প্রতিনিধি।

আমরা বেড়ে উঠেছি বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন ) দেখতে দেখতে। তখন দেশে একটিমাত্র চ্যানেল ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন নাম নিয়ে যাত্রা করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন নাম ধারণ করে। ২০০৪ সালে বিটিভি বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারের জন্য বিটিভি ওয়ার্ল্ড নামে প্রচার শুরু করে। বিটিভি এখন ইউটিউবেও দেখা যায়। সে সময় বিটিভি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকত না।

সরকার নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও বিটিভি উন্নতমানের সব অনুষ্ঠান প্রচার করত কি দেশি কি বিদেশি। দেশি অনুষ্ঠানে যেমন ছিল নাচ গান  আলোচনা সাহিত্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তেমনি বিদেশি অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্যে ছিল উল্লেখ করার মতো। বিটিভির আনন্দমেলা ঈদের নাটক নিয়ে বছর জুড়ে আলোচনা হতো। নাটকের সংলাপ থাকত সবার মুখে মুখে।

আমজাদ হোসেনের নাটকের সংলাপ দুবাই যামু টাকা দ্যান খুব সহজে আজকের ভাষায় ভাইরাল হয়ে যেত। ইমদাদুল হক মিলনের সাপ্তাহিক নাটক এর সংলাপ ছিঃ ছিঃ তুমি এত খারাপও ছিল আলোচিত। হুমায়ূন আহমেদ তো ছিলেনই। তাঁর কোথাও কেউ নেই নাটক দেশকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে। সাইখ সিরাজের মাটি ও মানুষের কথা এখনো অনেকে ভুলতে পারেন না (সম্প্রতি একজন শিক্ষক মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের ওপর ডক্টরেট করেছেন)।

বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতকে প্রমোট করেছে বিটিভি। যা আজও অব্যাহত আছে। হিরামনে দেখানো হতো সব আলেখ্য অনুষ্ঠান। আমাদের গ্রাম বাংলার বিভিন্ন লোক কাহিনী ও অঞ্চলভিত্তিক লোক সংস্কৃতির অনুষ্ঠান সুর লহরী (উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান) মালঞ্চ, বিষের বাঁশি এ ধরনের অনুষ্ঠানও ছিল। বগুড়া ইয়ুুথকয়ারের ভিন্নধর্মী পরিবেশনা। ফজলে লোহানীর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যদি কিছু মনে না করেন। হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি এখনো দাপটের সঙ্গে টিকে আছে।

একের পর এক ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়েছে উন্নতমানের সব ইংরেজি সিরিয়াল। টারজানের পর আসল সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান, বায়োনিক ওম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, ইনক্রেডিব্যাল হালক, নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার ইত্যাদি। এগুলো ছিল সব আলোচিত সিরিয়াল। যাকে বলে সুপার ডুপার হিট। আরো ছিল কোজাক, দ্য চিপস, হাওয়াই ফাইভ, দ্য এ টিম, দ্য এক্স ফাইল, দ্য বিল কসবি শো, হার্ট টু হার্ট, দ্য ফলগাই, লিটিল হাউজ অন দ্য পেইরি, রবিনহুড, হারকিউলিস, র‌্যাভেন, অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দাবাদ, রোভকোপ, আলিফ লায়লা ইত্যাদি ।

বড়দের জন্য ছিল ডালাস, ওশিন, অল দ্য রিভার্স রান অ্যাওয়ে, এগেনেস্ট দ্য উইন্ড, ফ্যামেলি টাইস, মিয়ামি ভাইস ইত্যাদি। ভালোভাবে ইংরেজি না বুঝলেও ভাষা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সিরিয়ালগুলো দেখতে ও বুঝতে। ইউরোপ আমেরিকায় যখন এই সিরিজগুলো প্রচারিত হতো তার প্রায় সমসাময়িক সময়েই আমরা এগুলো দেখেছি সে সময়ে। পরবর্তী পর্যায় বাংলায় ডাবকৃত ইরানি ছায়াছবি আমাদের মুগ্ধ করেছে।

নিয়মিত টিভি রিভিউ প্রকাশিত হতো পত্রিকায়। টিভি সমালোচনা লিখে কেউ কেউ জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। অনুষ্ঠানের মান খারাপ হলে কারণ দর্শাতে হতো। শাস্তিও পেয়েছেন দু’একজন। বিটিভির বাংলা সংবাদ ও নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে আমরা ভালো বাংলা উচ্চারণে বাংলা বলা শিখেছি। কারো উচ্চারণে আঞ্চলিকতার দোষ থাকলে বা ভালো উচ্চারণ না হলে মুরব্বিরা বলতেন বিটিভি দেখে সঠিক বাংলা উচ্চারণ শিখে নিতে। ইংরেজি পারি আর না পারি বিটিভির ইংরেজি নিউজ শুনে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করতেন।

সেই দিনগুলোতে বিটিভিতে প্রচার হতো সব উন্নতমানের ইংরেজি ছায়াছবি ও ডেইলি সোপ, যা আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই দেখেছে। বিরতিহীনভাবে আমরা এগুলো দেখেছি বাল্যে ও তারুণ্যে। আমাদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার বীজও ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিটিভি। তা আমরা হয়তো তখন  বুঝতে পারিনি। আমাদের প্রজন্মের উন্নত রুচি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বিটিভি।

তাই আমরা খুব সহজেই আজকালকার নাটক সিনেমার ভালো মন্দ মূল্যায়ন করতে পারি। বিটিভি আমাদের দেখা শোনা ও জানার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। আমাদের ক্ষুধা বেড়েছে মানসম্মত কাজের প্রতি। সস্তা নির্মাণ আমাদের টানতে পারছে না। আমাদের ভেতরে রয়েছে উন্নতমানের শিল্পবোধ। যা আমাদের অজান্তেই গড়ে উঠেছে। যার জন্য বিটিভির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা তো শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত সম্পর্কে জেনেছি বিটিভির কাছ থেকে। বিটিভি আমাদের চিন্তা শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, করেছে সৃজনশীল। দেশি সংস্কৃতির পাশাপাশি  আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিও জেনেছি বিটিভির মাধ্যমে। আমাদের মধ্যে একটা মানবিক বোধও ও সুন্দর মনোজগত সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বিটিভি। আসলে বিটিভি ছিল আমাদের কাছে একটা স্কুল বা ইনস্টিটিউটের মতো। যেখান থেকে বিনা বেতনে অনেক কিছু শেখা যেত।

বিটিভিতে এমন কিছু অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে, যে অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়ার সময় শহরে নিস্তব্ধতা নেমে আসত। অফিস থেকে লোকজন তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসত। বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি সমাগম কম হতো। শহরকে মনে হতো ভুতুড়ে শহর। আমাদের আলাপ আলোচনার একটি অংশজুড়ে ছিল বিটিভি। একেকটা অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা সপ্তাহ গড়িয়ে মাস পেরিয়ে যেত। এই বিদেশি সিরিয়ালের চরিত্রগুলো ছিল আমাদের হিরো। তাদের নামে ললিপপ পাওয়া যেত। ছিল ভিউকার্ড পোস্টকার্ড। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আবহ সঙ্গীত শুনে আমরা শিহরিত হয়ে উঠতাম। তাদের পোশাক আসাক চাল চলন চুলের কাট আমাদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। কোথায় গেল সেই দিন?

এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তখন একটি মাত্র মিডিয়া ছিল বলে দর্শকের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাই বিটিভি যা দেখাত সেটাই তারা দেখতে বাধ্য হতেন। সময়ের সঙ্গে মানুষের রুচিও বদলে গেছে। বিটিভি বদলাতে পারেনি। কিন্তু তার পরও বলতে হবে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিটিভি ছিল অনন্য। তাই ঘুরে ফিরে বিটিভির আলোচনা আসে বার বার আমাদের সামনে। এ সব বিষয় নিয়ে তুমুল  তর্ক বিতর্ক হতে পারে। তাতে বিটিভির সাফল্য কোনোভাবেই ম্লান হবে না একটুও। স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত সরকার বিটিভিকে প্রণোদনা দিয়েছে।

আর আজ গণতান্ত্রিক যুগে বিটিভি তার গহণযোগ্যতা হারাচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। দর্শক কমছে। বিজ্ঞাপনও কমে যাচ্ছে। একদিন যে বিটিভি একটা প্রজন্ম সৃষ্টি করেছিল বলে আমি দাবি করছি। আর আজকাল প্রজন্মের অনেকে জানেই না তাদের বাড়িতে বিটিভি কত নম্বর চ্যানেলে আছে বা নেই। বাংলাদেশি সংস্কৃতি নির্মাণে  বিটিভির অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের জীবনের অনেক সুন্দর মুহূর্তগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিটিভির স্মৃতি। পেছনে ফিরে তাকালেই ভেসে ওঠে সেই দিনগুলো। তখন দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এমন একটা ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছিল যে বিটিভি স্বায়ত্তশাসন পেলেই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হয়ে যাবে। আর আজ এমন অবস্থা হয়েছে যে বিটিভির স্বায়ত্তশাসন দাবি এখন কোনো আলোচ্যসূচিতে নেই।

লেখক: মাসুদ কামাল হিন্দোল - সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি