Image

বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ এবং আজকের বাংলাদেশ

ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে।

পদ্মা মেঘনা যমুনা কর্ণফুলী দিয়ে বহু পানি বঙ্গোপসাগরে নিপতিত হয়েছে। পেছন ফিরে তাকালে সেই দিনে স্বদেশের স্বাধীন মাটিতে পা রেখে জাতির হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটির মনের অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থান, দেশের জন্য তিনি কী করতে চেয়েছিলেন, দেশবাসীকে কী দিকনির্দেশনা দিতে চেয়েছিলেন, তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা প্রতিক‚লতা ও পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মধ্যে ওই দিনের বক্তৃতার দিকনির্দেশনার প্রতি অবিচল থেকেই তিনি নবজাত রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় অগ্রসর হচ্ছিলেন।

পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার স্বাদই কেবল নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের নতুন ভিত সৃষ্টির সব কিছু তিনি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু অমোঘ সত্যের মতো তিনি যে কথা বলেছিলেন, জীবন দিয়ে সেই সত্যেরই প্রমাণ দিয়েছেন। ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে তিনি নিঃশেষে প্রাণ দিয়ে গেছেন। জনগণের প্রচণ্ড ও সৃষ্টিশীল কাজে আজন্ম বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু। আমাদের গৌরবমণ্ডিত বিজয় মানেই ছিল পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরক্ষণ থেকে পাকিস্তানের রঙ্গমঞ্চে যে পরাজয়ের বিয়োগান্তক বিষাদময় ছত্রখান নাটক চলতে থাকে, তা খুবই চিত্তাকর্ষক এবং নাটকের এক পর্যায়েই পরাজিতরা আমাদের জাতির পিতাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল এ নেতা মহাবাঙালি ছিলেন, একজন আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীন চেতনা সমৃদ্ধ একজন ব্যাঘ্র মানব। তার গলার স্বরের সঙ্গে অন্য কোনো বাঙালির স্বরের মিল ছিল না। কণ্ঠস্বর দিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির পরিচিতি ঘটাতে হয়, তাহলে শেখ মুজিব ছিলেন এর অদ্বিতীয়। তার কণ্ঠ থেকে মাঝে মাঝে অগ্নিবীণা নিঃসৃত হতো। সাধারণ মানুষ তাই তার কণ্ঠকে বজ কণ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। ব্যাঘ্রের গর্জন যেমন ছোটখাটো বন্য জন্তুকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলে, তেমনি শেখ মুজিবের কণ্ঠও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের একইভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত। তার এক একটা শব্দ ও এক একটা বাক্যে পাকিস্তানি শাসকদের অন্তর কেঁপে উঠত। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম তার এই ঘোষণা রমনা রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে প্রকম্পিত করেছিল। প্রতিপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, শেখ মুজিব ও বাংলার জনগণ আর পাকিস্তানি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি নয়। পরিচয় পরিবর্তন করে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।

তিনি ছিলেন ওইসব বিশ্বের মহান নেতাদের একজন, যারা জীবদ্দশায় তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে গেছেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বাস্তবে স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলা তো তারই কৃতিত্ব। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ তাদের তৎকালীন আবাসভ‚মি পূর্ববাংলা পাকিস্তান থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিল। যে মহান নেতার একক নেতৃত্বে এ মহান কাজটি সুুসম্পন্ন করা হয়েছিল, তিনি হচ্ছেন বাংলার রাখাল রাজা, অবিসংবাদিত একক নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯২০ সালে ব্রিটিশরা যখন এই অঞ্চল শাসন করেছিল, তখন এই বিপ্লবী নেতা ছোট্ট খোকা হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া নামক নিভৃত এক পল্লীতে। সেই খোকা যে মহিরুহ আকার ধারণ করে তার পরাধীন জাতিসত্তাকে স্বাধীন করতে সক্ষম হবেন, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কথাবার্তা, চালচলন, চিন্তাচেতনা, অনুভ‚তি-আবেগ মিশ্রিত এত বড় মহাপুরুষ বাংলার মাটিতে এর আগে আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি। বাঙালির সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে বাঙালি এরূপ বিজয় আর কখনো উপভোগ করেনি। একটা বিজয়ী স্লোগান, একটা স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন জাতীয় সঙ্গীত অর্থাৎ স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা এমনভাবে ইতোপূর্বে কেউ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তাই বলা যায়, তিনি একজন সার্থক জাতির জনক। যেসব দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বিজয়ের পরে আসে, তাদের জন্য বিপর্যয়। কোনো দেশে শতভাগ লোক স্বাধীনতার দাবিদার হতে পারে না। কিছু বিরোধিতা থেকেই যায়। আর ওই বিরোধিতাই চেষ্টা করে বিপর্যয় ঘটানোর, বঙ্গবন্ধুর বেলায় তাই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু ভালো করে জানতেন, বিজয়কে সার্থক ও সুসংহত করতে হলে, শত্রুদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে হবে। বিজয়ের পর অন্যান্য দেশে বিরোধীদের নিধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজয়কে সুসংহত করার চেষ্টা করা হয়। মানবতাবাদী শেখ মুজিবুর রহমান ওই শত্রু নিধন প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অনেক শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। চরম অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায়। একটা সশস্ত্র বিপ্লবের পরও তিনি দেশ পরিচালনা করতে চেষ্টা করেছিলেন।

বিজয়কে সুসংহত করার প্রয়োজনেই সবকিছু কঠোর হস্তে দমন করে তিনি যখন আসল কাজটি শুরু করার জন্য পদক্ষেপ নিলেন, তখনই তাকে হত্যা করা হলো। পরিচালনা করা হলো দেশকে প্রতিক্রিয়ার ধারায়। স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিপক্ষ বনে গেলেন। তারপর ২১ বছর যা হওয়ার তাই হয়েছে! উল্টোপথের যাত্রী সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটানোর অপচেষ্টা। প্রতি দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ের পর স্বাধীনতাকে সুসংহত করার চেষ্টাই হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবীরা প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকেন। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে বিশেষ করে, মুক্তি- যোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রেখে প্রতিবিপ্লবীদের আমরা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারিনি। হয়তো আমাদের অনেক সিদ্ধান্তে ভুল ছিল। স্বাধীনতার মর্মবাণীকে হৃদয় দিয়ে আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধু দেশে এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষও যেন মুক্তির স্বাদ পায়। প্রতিটি মানুষ যাতে তার মানবিক অধিকার উপভোগ করতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি কখনো শোষকদের বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার সংরক্ষিত একটি বাংলাদেশ। তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন, তিনি শোষিতের পক্ষে, শোষকের পক্ষে নন। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে শোষণ করছে, সুবিধাবাদী শোষক শ্রেণি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার সুফল পাইনি। গুণগতভাবে জাতিসত্তায় যে প্রগতিশীল উন্নয়নের ধারা প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের লক্ষ্য ছিল, তা অর্জিত হয়নি।

তাই ১০ জানুয়ারি বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। ওইদিন দেশে ফিরে এসে তিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সুসংহত করার লক্ষ্যে মূল ভিত রচনা করেন। তার অকালমৃত্যুর কারণে আমাদের চরম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে। তার অসমাপ্ত কাজ তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সমাপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তা ভিন্ন হওয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অত্যন্ত সুকৌশলে অগ্রসর হতে হচ্ছে। বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। যে আর্থসামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, বর্তমান সময়ে তা আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বস্তুনিষ্ঠ বর্তমান বাস্তবতা যে দিকনির্দেশনা দেয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাই অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন। তাই তার অনেক সিদ্ধান্তকে সাধারণ জনগণ ভ্রান্ত বলে মনে করেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সঠিকভাবে তারা তৎপর হয়ে ওঠেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেভাবে আত্মসচেতন হওয়ার কথা, তা হতে পারেনি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, চেতনাই রয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে তার দূরদর্শিতা তার অনুসারীরা অনেকেই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। তার অকালমৃত্যুর কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে এখন কালো অধ্যায় বলে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার প্রয়োজনেই তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ওই কর্মসূচি ছিল আর্থসামাজিক মুক্তির দিকনির্দেশক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তাঁর একটি স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন ছিল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের। স্বপ্ন ছিল এদেশের খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। সেই স্বপ্ন নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে পা রাখা মানুষটি কি ভাবতে পেরেছিলেন, নয় মাসের যুদ্ধে কী তাণ্ডব চালিয়ে গেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা? ভাবতে পারেননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষের তখন খাদ্যের নিরাপত্তা নেই। অনেকেরই আশ্রয় নেই। কিন্তু বিশ্বাস ছিল অটুট। মানুষ বিশ্বাস করেছিল তিনি ফিরলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে এই দেশ।

তাঁর জাদুকরী সাংগঠনিক শক্তিতে তিনি আবার নতুন করে এই দেশটিকে গড়ে নিতে পারবেন। পারবেন সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। এই এক অসাধারণ গুণ ছিল তাঁর। পরিশেষে বলব, তাঁর জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনার শুরুর এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তাঁর নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি। গড়ে তুলতে পারি তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক- রায়হান আহমেদ তপাদার : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ।

মানবকণ্ঠ/এইচকে