Image

পুঁজিবাজারের ভয়াবহ পতনে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা

পুঁজিবাজারের ভয়াবহ পতনযাত্রায় কোনো ছেদ নেই। বছর ধরে চলায় এই পতনযাত্রায় নিঃস্ব হতে চলেছে বিনিয়োগকারীরা। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে কাজ হয়নি। বিশ্লেষকগণ এর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। কোনো কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। ভালো কোম্পানির শেয়ারও পানির দরে বিক্রি করে দিতে পারলে যেন বেঁচে যান তারা। ফলে বাজারে দেখা দিয়েছে তারল্য সঙ্কট।

গতকাল মঙ্গলবারও বড় দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই)। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সূচক এই এক দিনেই কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। আগের দিন সোমবারও ৮৯ পয়েন্ট কমেছিল এই সূচক। ফলে এই সূচক ৪ হাজার পয়েন্টের কাছাকাছি নেমে এসেছে। যা এই সূচক শুরুর চেয়েও কম। ২০১৪ সালে এটি শুরু হয়েছিল ৪০৫০ পয়েন্ট দিয়ে। গতকাল এটি নেমে গেছে ৪০৩৬ পয়েন্টে। এদিকে পুঁজিবাজারের অস্থিরতার মধ্যে এ নিয়ে ‘জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২০ জানুয়ারি দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

এই অবস্থায় প্রায় চার মাস পরে ফের বিনিয়োগকারী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এর আগে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে বিক্ষোভ করেছিল বিনিয়োগকারীরা। তাদের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি বন্ধ করতে গত বছরের ২৭ আগস্ট ডিএসইর পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরপর বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ। এদিকে গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে পুঁজিবাজার নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ক্রান্তিকাল থেকে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গভর্নর। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করা এবং উন্নয়নের জন্য এ পর্যন্ত ডিএসই যতগুলো প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে থেকে সর্বোত্তম প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন হলেও তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। পতনের প্রবণতা দেখে অনেকেই বিস্মিত। তবে তারা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সঙ্কট আর সুশাসনের অভাবে শেয়ারবাজারে এই দুরবস্থা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে যে বড় দরপতন হচ্ছে এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার বিক্রি করছেন। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারের ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে তারা আর কোনো ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে তাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা অশনিসঙ্কেত। কেন যেন বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এদিন ডিএসইতে মাত্র ৩২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে কমেছে ২৯৩টির। ৩০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৭ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৩৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আগের দিন এ সূচকটি কমে ৮৯ পয়েন্ট। এর আগে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমে ২৬১ পয়েন্ট। এতে শেষ ৮ কার্যদিবসে সূচকটি কমল ৪১১ পয়েন্ট। এমন পতনের কবলে পড়ে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকটি শুরুরও নিচে নেমে গেল। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক হিসেবে ডিএসইএক্স চার হাজার ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ হিসেবে শুরুর অবস্থান থেকে সূচকটি এখন ১৯ পয়েন্ট কম রয়েছে।

অবশ্য প্রধান মূল্য সূচকের থেকেও করুণ দশা বিরাজ করছে ডিএসইর অপর সূচকগুলোর। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ অনেক আগেই শুরুর নিচে নেমে গেছে। এক হাজার ৪৬০ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হওয়া সূচকটি এখন এক হাজার ৩৬১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। মঙ্গলবার এ সূচকটি কমেছে ২৬ পয়েন্ট।

ডিএসইর আরেক সূচক ‘ডিএসই শরিয়াহ্’। ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি এ সূচকটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এ সূচকটি ছিল ৯৪১ পয়েন্টে। গতকাল মঙ্গলবার লেনদেন শেষে সূচকটি ২২ পয়েন্ট কমে ৯০৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বৃহৎ বা বড় মূলধনের কোম্পানির জন্য চলতি বছরে ‘সিএনআই-ডিএসই সিলেক্ট ইনডেক্স (সিডিএসইটি)’ নামে নতুন সূচক চালু করেছে ডিএসই। বছরের প্রথমদিন ১ জানুয়ারি থেকে অফিসিয়ালি ডিএসইর ওয়েবসাইটে সূচকটি উন্মুক্ত করা হয়। ৪০টি কোম্পানি নিয়ে শুরু হওয়া সূচকটির ভিত্তি ভ্যালু ধরা হয় ১০০০ পয়েন্ট। তবে এখন সূচকটি ৮১১ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

সব ক’টি মূল্য সূচকের এমন উল্টোযাত্রায় প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। অনেক বিনিয়োগকারী দফায় দফায় দাম কমিয়েও কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। এতে দিন যত যাচ্ছে শেয়ারের দাম তত কমছে, আর ভারি হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা। গত এক বছরে বাজার মূলধন কমেছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
গতকাল ডিএসইতে ২৯৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন হয়েছে, তার মধ্যে ১৪৫টিরই দাম কমেছে ৩ শতাংশের ওপরে। ৫ শতাংশের ওপরে দাম হারিয়েছে ৫৭টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৬ শতাংশের ওপরে দাম কমেছে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের। এমন দাম কমার পর অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।

এই পতনের লেনদেন চলাকালীনই রাজধানীর মতিঝিলে রাস্তায় নেমে আসেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’র ব্যানারে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে পুঁজিবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সঙ্গে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) দুরবস্থায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারটির সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৯৫ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৪৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ২১টির, কমেছে ২০৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির।

পুঁজিবাজার নিয়ে ‘জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়: পুঁজিবাজারের অস্থিরতার মধ্যে এ নিয়ে ‘জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২০ জানুয়ারি দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব ড. নাহিদ হোসেনের সই করা এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পুঁজিবাজার উন্নয়নে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে অংশীজনের মতবিনিময় সভার প্রস্তাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন কাজ সমন্বয় ও তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের গঠিত কমিটি এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরের সভাপতিত্বে দুপুর ২টায় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুদ বিশ্বাস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এমন সময় জরুরি সভা ডাকা হলো, যখন পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতন হচ্ছে। সর্বশেষ আট কার্যদিবসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৪১১ পয়েন্ট। এমন দরপতনের কবলে পড়ে ডিএসইর সবকটি মূল্য সূচক শুরুর অবস্থানের নিচে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা।

মানবকণ্ঠ/জেএস