Image

থ্যালাসেমিয়া কি ও তার চিকিৎসা

আরিফ, ১২ বছর বয়সের এক কিশোর। এই বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা, ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে ওঠার কথা, স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা; বড় হওয়ার স্বপ্ন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। অথচ এসবের কিছুই সে করছে না। কারণ, তার শরীর খুব দুর্বল, তার পেটের দুটো চাকা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী। ৩ বছর বয়সেই তার এ রোগ ধরা পড়ে। তার ছোট ভাইটিও একই রোগে আক্রান্ত।

ডাক্তার সাহেবরা বলেছিলেন, এক মাস পর পর নিয়মিত রক্ত দিলে সে সুস্থ থাকবে। কিন্তু রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়া-আসা আর নিয়মিত রক্ত যোগাড় করা তার দরিদ্র পিতার জন্য একটা কঠিন কাজ। তাই সে নিয়মিত রক্ত নিতে আসতে পারে না। যখন শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, তখন তার পিতা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বেশ কিছু দিন ধরে ডাক্তার সাহেবরা লৌহ অপসারণকারী ওষুধের কথা বলছেন। কিন্তু এসব দামি ওষুধ কেনা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই সে আর স্বপ্ন দেখে না। সে এখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। এই আরিফ আমাদের শিশু বিভাগের একটি পরিচিত মুখ। বাংলাদেশে এরকম আরিফের সংখ্যা অনেক। এদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

থ্যালাসেমিয়া কি?

থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক ধরনের মারাত্মক রোগ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো গঠিত হয় না এবং রক্তের লোহিত কণিকা স্বাভাবিক সময়ের আগে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে রোগী রক্ত শূন্যতায় ভোগে ও শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগ কিভাবে বিস্তার লাভ করে?

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। যে বংশে এ রোগ আছে, সেই বংশের লোকজনই বংশানুক্রমে এটা বহন করে। পিতা মাতা থেকে সন্তানদের মধ্যে এ রোগ জিন (বেহব) এর মাধ্যমে প্রবেশ করে।

বাহক কি?

যাদের শরীরে থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন আছে, কিন্তু রোগের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না, তাদের থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বলা হয়। এরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তবে এরা এদের সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগের বিস্তার ঘটায়। পিতা-মাতা উভয়েই বাহক হলে থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হবার সম্ভাবনা থাকে, নতুবা নয়। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। কাজেই বিয়ের আগে সবারই জেনে নেয়া দরকার, তিনি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না।

কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না তা কিভাবে জানা যাবে?

এটা জানতে হলে রক্তের বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করাতে হবে। আমাদের দেশে যে পরীক্ষা দ্বারা এটা নির্ণয় করা হয়, তাকে ‘হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস’ বলা হয়।

থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা

থ্যালাসেমিয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর ৭৪৮৩ জন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জš§ হয়। সারা দেশে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা ৩,৭২,১৫৪ জন। (সূত্র: ঢাকা শিশু হাসপাতাল থ্যালাসেমিয়া সেন্টার) অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের সুবিধা না থাকায় নিয়মিত বিরতিতে রক্ত গ্রহণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রক্তের লৌহ অপসারণকারী ওষুধ গ্রহণই আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রধান চিকিৎসা। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতি ৩-৪ সপ্তাহ অন্তর অন্তর রক্ত নিতে হয়। এই বিপুল সংখ্যক থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য নিয়মিত রক্তের ব্যবস্থা করা একটি দুরূহ ব্যাপার।

লেখক - ডা. মুজিবুল হক : সহকারী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।

মানবকণ্ঠ/জেএস