Image

স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো বাংলাদেশের একদিন

বাংলাদেশে এখনো দিনের বেলাতে শীতের কোনো আমেজই নেই। রাতে এখনো সর্বত্র শীতের পোশাক পড়া শুরু হয়নি। সেখানে হিমালয় কন্যা নেপালে প্রচণ্ড শীত। দিনের বেলাতেই শীতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারি কাপড় পরে থাকতে হয়। সন্ধ্যা নামার পর শীতের তীব্রতা আরো বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ থেকে আসা আগন্তুকদের জন্য যা সম্পূর্ণ বিপরীত। শীতের এই তীব্রতা থাকে আবার সূর্যের প্রখরতা না বাড়া পর্যন্ত। সেই তীব্র শীত গতকাল অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল এস এ গেমসে বাংলাদেশ দলের একের পর এক স্বর্ণ জয়ের মাধ্যমে।

যেখানে প্রথম সাত দিনে এসেছিল সাত স্বর্ণ, সেখানে কালই এসেছে সাত স্বর্ণ। ছয়টি আরচ্যারি থেকে, একটি মেয়েদের ক্রিকেটে। এর আগে গেমসের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশ জিতেছিল তিনটি স্বর্ণ। সব ক’টিই ছিল কারাতে ইভেন্টে। দিনটিতে বাংলাদেশের সোনালি দিন হিসেবে অনেকেই উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু কাল সেটিকেই ছাড়িয়ে গেছে লাল- সবুজের বাংলাদেশ। প্রকৃত স্বর্ণালি দিন ছিল বলা যায় কালই। এস এ গেমসের ১৩তম আসরে বাংলাদেশ শুধু নিজেদের সেরা দিনই উপহার দেয়নি। এস এ গেমসের ইতিহাসে দেশের বাইরেও সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড গড়েছে। কালকের সাতটি নিয়ে বাংলাদেশের মোট স্বর্ণ জয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চৌদ্দটিতে। এর আগে দেশের বাইরে সেরা সাফল্য ছিল ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ গেমসে। বাংলাদেশ জিতেছিল সাতটি স্বর্ণ। আর ঘরের মাঠে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জিতেছিল ২০১০ সালে ১৮টি। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে প্রথমবার আয়োজক হয়ে বাংলাদেশ জিতেছিল ৯টি সোনা। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার আয়োজক হয়ে নিজেদের ছাড়িয়ে গিয়ে জিতেছিল ১১টি স্বর্ণ। ২০১০ সালে তৃতীয়বার আয়োজক নিজেদের আবার ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১৮টি স্বর্ণ জিতে। এবারের গেমসে সেরা দিন উপহার দিলেও পদক তালিকায় বাংলাদেশ কিন্তু নিজেদের অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে পারেনি। ১৪ স্বর্ণ জিতে তারা পাঁচেই আছে। সবার উপরে আছে ভারত। এরপর নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান।

এস এ গেমসের মূল ভেন্যু নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। ১৩তম আসরের শুরুতেই উদ্বোধনী দিনের পর থেকেই বাংলাদেশের স্বর্ণ পদক আসতে শুরু করে। দ্বিতীয় দিন একটি ও তৃতীয় দিন আসে তিনটি। সব ক’টিই ছিল কাঠমান্ডুতে। কিন্তু এর পর থেকেই স্বর্ণের খরা শুরু হয়। টানা তিন দিন কোনো স্বর্ণ জিততে পারেনি। অথচ এবার ভারত তাদের সেরা দল নবা পাঠানোতে বাংলাদেশের স্বর্ণ জেতার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ দিন কোনো স্বর্ণ জিততে না পারায় সেখানে ভাটার টান পড়ে। তবে সেই স্বর্ণ আবার পেতে শুরু করে সপ্তম দিন থেকে। কিন্তু কাঠামান্ডুতে নয়, পোখরায়। এই পোখরা গেমসের অন্যতম ভেন্যু। সপ্তম দিন যে তিনটি স্বর্ণ জিতেছিল তার দুটি ছিল পোখরায়, অপরটি কাঠমান্ডুতে। কালকের সব ক’টিই আবার পোখরায়।

প্রচণ্ড শীতে বাংলাদেশের দিনটি শুরু হয়েছিল আরচ্যারির রিকার্ভ রোমান সানা, তামিমুল ইসলাম ও হাকিম মোহাম্মদ রুবেল দলগত ইভেন্টে স্বর্ণ জয়ের উত্তাপ দিয়ে। তারা ৫-৩ সেটে হার মানায় শ্রীলঙ্কার আরচারদের। এই স্বর্ণ আবার দেশের বাইরে গেমসের ইতিহাসে ছিল নতুন রেকর্ড গড়ে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের। এ দিন আরচ্যারির ছয়টি ইভেন্টের সব ক’টিতেই বাংলাদেশ স্বর্ণ জিতে নেয়। রিকার্ভ ইভেন্টে প্রথম তিনটি। পরের তিনটি কম্পাউন্ড ইভেন্টে। তাদের স্বর্ণ জয়ের মাঝে আবার যোগ হয় মেয়েদের ক্রিকেটের স্বর্ণ।
প্রথম স্বর্ণ জয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বর্ণ জিতে নেয় মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টে। এবার মেয়েদের কাছে ধরাশায়ী ভুটানের আরচাররা ৬-০ সেটে। বাংলাদেশের হয়ে লাল-সবুজের পতাকাকে সবার উপরে তুলে ধরেন বিউটি রায়, ইতি খাতুন ও মেহনাজ আক্তার মনিরা। এরপরের স্বর্ণ রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে। দেশ সেরা আরচার রোমান সানা ইতি খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে ৬-২ সেটে ভুটানকে পরাজিত করেন।

সকালটা শেষ হয় রিকার্ভ ইভেন্টে স্বর্ণালি হাসিতে। দুপুরের পর রিকার্ভ ইভেন্টেও আরচাররা সমান তালে তাল মেলালে বারবার বেজে উঠতে থাকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। পুরুষ দলগত বিভাগে ভুটানকে ২২৫-২১৪ স্কোরে হারিয়ে শুরু হয় কম্পাউন্ডে বাংলাদেশের স্বর্ণ জয়ের মিছিল। এই ইভেন্টে বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা ছিলেন- অসীম কুমার দাস, সোহেল রানা ও মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান। পুরুষদের অনুসরণ করে মেয়েরাও দলগত ইভেন্টে জিতে নেন স্বর্ণ। তারা ধরাশায়ী করেন শ্রীলঙ্কাকে। সুস্মিতা বণিক, শ্যামলী রায় ও সোমা বিশ্বাসকে নিয়ে গড়া বাংলাদেশ জিতে ২২৬-২১৫ পয়েন্টে। দিনের শেষ ইভেন্ট ছিল কম্পাউন্ড মিশ্র দলগত। বাংলাদেশের প্রতিযোগী ছিলেন জুয়েল রানা-রোকসানা আক্তার জুটি। তারা স্বাগতিক নেপালের প্রতিযোগীদের ধরাশায়ী করেন ১৪৮-১৪০ পয়েন্টে। আরচ্যারির ১০ ইভেন্টের সব ক’টিতেই বাংলাদেশ ফাইনালে উঠেছে। আজ বাকি চারটি ইভেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। এই চারটিতেই বাংলাদেশের স্বর্ণ জয়ের সম্ভাবনা খুব বেশি।

স্বর্ণ জয়ের পর বাংলাদেশের সেরা আরচার ও টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা রোমান সানা গত এস এ গেমসে খেলতে পারেননি ইনজুরির কারণে। এ নিয়ে তার অনেক আফসোস ছিল। সেই আফসোস যেন এবার স্বর্ণ জিতে তিনি মেটাতে পেরেছেন। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করছি যে গোল্ড অর্জন করতে পেরেছি। বড় কথা হচ্ছে ২০১৬ সালে এস এ গেমসে বড় একটা ইনজুরির কারণে খেলতে পারিনি। তখন অনেক দুঃখ লেগেছিল। আজ (গতকাল) দিনের শুরুটাও হয়েছে সোনা জিতে। দলগত ও মিশ্র দলগত মিলিয়ে দুটো গোল্ড পেয়েছি। ধরতে গেলে এটা আমার ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন। আশা করছি, আগামীকাল (আজ) এককের ইভেন্ট আছে। আল্লাহপাক সহায় থাকলে, ইনশাআল্লাহ কালও (আজ) জিততে পারব।’

মানবকণ্ঠ/এইচকে