Image

সাইবার আক্রমণের বেশি শিকার হচ্ছে নারীরা

অনলাইন ডেস্ক: বেশ কিছুদিন ধরে নাফিসার ইউটিউব চ্যানেলে তাকে দুশ্চরিত্রা বানিয়ে বাজে বাজে কমেন্ট করছে কেউ। কে করছে কেনো করছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না নাফিসা। বাধ্য হয়ে কমেন্টগুলো ডিলিট করে কমেন্ট বক্স বন্ধ করে রাখতে সে বাধ্য হয়। কিন্তু কমেন্ট ডিলিট করার আগেই এসবের স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছে তার কিছু সহকর্মী। বিভিন্নভাবে তাকে কটুকথা বলেই যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে বারবার তাকে হেয় করছে, অপমান করছে। যেনো কতো বড় একটা অপরাধী সে। কিছুদিন ধরে অফিসে যাচ্ছেন না নাফিসা। মনমরা হয়ে ঘরে পড়ে থাকেন। বাবা-মা বারবার জিজ্ঞেস করলেও কিছুই বলতে পারছেন না তিনি। ভয় পাচ্ছেন যদি বাড়িতে কেউ জানে উল্টো তাকেই ভুল বুঝবে সবাই। প্রচণ্ড মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়লেন বেচারি।


আরেক ভুক্তবোগী ফাইজা রহমান। লেখাপড়া করেন নাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখতে সুশ্রী ফাইজাকে ভার্সিটির অনেক ছেলেই পছন্দ করে। কিন্তু ফাইজা খুব পড়ুয়া। ঘরকুনো আর চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। ফাইজাকে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে ফাইজার ছবি দিয়ে নোংরা ছবি বানিয়ে বন্ধুদের মোবাইলে ছড়িয়ে দেয় কয়েকজন সহপাঠি। মূলত ফাইজা তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার প্রতিশোধ নেয় ওরা।


এদিকে, এসব জানতে পেরে ফাইজার বাবা-মা তার লেখাপড়া বন্ধ করে তার জন্যে পাত্র খোঁজা শুরু করে। বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হবেন তার বাবা-মা। কাঁদতে কাঁদতে ফাইজার জীবন দুর্বিষহ। অথচ কিভাবে কি হলো কিছুই জানতে না পারলেও সামাজিকভাবে সম্মানহানী ঘটলো মেয়েটার।

নাাফিসা আর ফাইজার মতো সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন অনেক নারীই। পুরুষরাও হচ্ছেন।

 

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ জানান, ’পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে বিশেষভাবে নারীদের সাইবার বুলিং -এর ক্ষেত্রে সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেন্ডার বিবেচনায় শতকরা ৭০ ভাগ নারী ও ৩০ ভাগ পুরুষ সাইবার বুলিং এর শিকার হন। সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩ অনুযায়ী সাইবার বুলিং আমলযোগ্য অপরাধ না হওয়ায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আসামিকে পুলিশ হেফাজতে নেয়ার বিধান করা হয়েছে। তবে, শুধু শাস্তি দিয়ে সাইবার অপরাধ দমন সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাইদ নাসিরুল্লাহ। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাইবার অপরাধ কমানো সম্ভব।


সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের অধীনে করা ’বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা ২০২৩’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, আড়াই বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির ৪০৬টি মামলার মধ্যে অনলাইন প্রতারণার মামলাই ৯৮টি, যা মোট মামলার প্রায় ২৪ দশিমক ১৩ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে (হ্যাক করে) অনলাইনে হয়রানির ঘটনা ৯৭টি (২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ)।

এছাড়া অনলাইনে মানহানিকর বক্তব্য ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে ৭৮টি (১৯ দশিমক ২১ শতাংশ) এবং ব্যাংক-মোবাইলিফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণার ৭২টি মামলা (১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ) রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সাইবার অপরাধের অভিযোগে ৬১টি (প্রায় ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ) মামলা হয়েছে। সাইবার জগতে নারী ভুক্তভোগীদের সহায়তা দিতে ২০২০ সালে গঠিত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ইউনিটে ৩০ এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়ে ৩৪ হাজার ৬০৫। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৬ হাজার ৫৯২। অভিযোগকারীদের মধ্যে আট হাজার ৯৪৭ জন ভুক্তভোগী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন।


সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনে সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেছেন, জেন্ডার ভিত্তিক তুলনামূলক পরিসংখ্যানে সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীদের হার বেশি (৫৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ) তবে এর মধ্যে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি হ্যাকিং বিষয়ক অভিযোগ করেছেন সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ পুরুষ।

সাইবার আক্রমণ থেকে বাঁচতে তার কিছু পরামর্শ :
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভুক্তভোগীর তালিকায় শীর্ষে। সুতরাং তাদের মাঝে বেশি বেশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।

২. একই পাসওয়ার্ড বার বার ব্যবহার না করা।

৩. অনেকেই পাসওয়ার্ডকে জটিল ও দীর্ঘ করতে গিয়ে ভুলে যাওয়াসহ বিভিন্ন ঝামেলায় পড়েন। সেক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড হিসেবে পছন্দের কোনো একটি বাক্য ব্যবহার করা যেতে পারে। একইসাথে আইডি লগ ইনে টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন বা দুই স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ব্যবহার করা।

৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা।

৫. নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ার সেটিংসে গিয়ে প্রাইভেসি বিষয়ক ফিচারগুলো পড়া এবং নতুন যোগ হওয়া ফিচারগুলো সম্বন্ধে ধারণা নেয়া।

৬. বছরে অন্তত তিন বার পাসওয়ার্ড বদলানো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার বুলিং -এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ যে বা যারাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন- এটি একজন ব্যাক্তিকে সামাজিক, মানসিক ও পেশাগত দিক থেকে হেয় প্রতিপন্ন করছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি মাধ্যমে প্রশমন করা সম্ভব। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে দেশের সাধারন মানুষকে বোঝাতে পারলে ধীরে ধীরে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে মানুষ সাবধান হবেন এমন প্রত্যাশা সবার।
সূত্র : বাসস