Image

মা ও মেয়ের ভাওয়াইয়ার সুরে মেলবন্ধন দুই বাংলার

পার্থ নিয়োগী: ভাওয়াইয়া দুই বাংলার উত্তরাঞ্চলের মাটির গান। বাংলার লোকসঙ্গীতের সবচেয়ে বড় অহংকার ভাওয়াইয়া। ৪৭ এর দেশ ভাগের ফলে কাঁটাতার দুই বাংলার মাঝে উঠলেও দুই বাংলার উত্তরাঞ্চলে ভাওয়াইয়া চর্চা থেমে থাকেনি।  পরিচিত জনপ্রিয় শিল্পীদের পাশাপাশি প্রচুর নতুন শিল্পী উঠে আসছে ভাওয়াইয়া গানে দুই বাংলাতেই। ফেসবুক হয়ে উঠেছে দুই বাংলার ভাওয়াইয়া শিল্পীদের মেলবন্ধনের স্থান। ফেসবুকের মাধ্যমে বহু ভাওয়াইয়া শিল্পী আজ সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে দুই বাংলায়। এমনই একজন হলেন কোচবিহারের অতিপরিচিত জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের শিল্পী প্রতিমা দাস। তিনি শুধু ভাওয়াইয়া গান না । একই সাথে নিজে লেখেন ও সুর করেন ভাওয়াইয়া গানে।  ছোটবেলায় পুজো মন্ডপে গান বাজত। আর সেই গান শুনে প্রতিমা দেবীর মায়ের মনে আশাছিল একদিন মন্ডপের মাইকে তার মেয়েরও গান বাজবে। আর মায়ের সেই স্বপ্ন সফল করে দেখিয়েছেন প্রতিমা দেবী। কিন্তুপ্রতিমা দেবীর এই সাফল্য মা দেখে যেতে পারেননি। সেই আক্ষেপ আজও ধরা পড়ে ফেসবুকে প্রতিমা দেবীর লেখায়। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের ও অসমের গোয়ালপাড়ার একজন জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পী প্রতিমা দাস আজ।  তবে তার ভাওয়াইয়া গানে মুগ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গান প্রেমীরাও। বর্তমান যুগটা ফেসবুকের। ফেসবুকে বলতে গেলে শত ব্যাস্ততার মাঝেও ভাওয়াইয়া গান নিয়ে হাজির হন তিনি। ফেসবুকের সুবাদে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেও তার নাম আজ ছড়িয়ে পরেছে। নিজের লেখা গানের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের ও অসমের শিল্পীদের এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের শিল্পীদের গান গাইতে দেখা যায় প্রতিমা দেবীকে। তবে তিনি একা নন। মাঝেমধ্যেই তার সাথে ভাওয়াইয়া গান নিয়ে একইসাথে হাজির হন তার মেয়ে মৃত্তিকা দাস।  অত্যন্ত সিরিয়াস শিল্পী মৃত্তিকা। মায়ের যথার্থ উত্তরসূরী হয়ে উঠছেন তিনি। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী মৃত্তিকা সিকিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিউজিক নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করেছে। পড়াশোনা, গানের পাশাপাশি অনলাইন পোষাকের নিজস্ব ব্রান্ডের একটি ব্যবসাও চালায় মৃত্তিকা। এরই ফাঁকে মায়ের সাথে ফেসবুকে ভাওয়াইয়া গান নিয়ে হাজির হয় সে। মা- মেয়ের জুটিতে তাদের গাওয়া ভাওয়াইয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে শ্রোতাদের মন।  ইতিমধ্যেই ফেসবুকে মা-মেয়ের জুটিতে গাওয়া গীদাল নজরুল ইসলামের লেখা ভাওয়াইয়া গান ‘ আইসো মোর কালাচান’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশেও। মা-মেয়ের জুটিতে গাওয়া ‘ ও বৈদেশি প্রান বন্ধুয়ারে’ ,’ কালা তোর দোতরাং ডাং’, ‘ ও মুই নাচং নাচং রে’ ভাওয়াইয়া গানগুলি দুই বাংলার ভাওয়াইয়া প্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে।   রংপুরের প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া গবেষক ও ভাওয়াইয়া তথ্যচিত্র নির্মাতা আশারাফুজ্জামান বাবু প্রতিমা দেবী ও মৃত্তিকাকে ভাওয়াইয়া গানের গর্ব বলেছেন।

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী প্রিন্স অফ ভাওয়াইয়া হরলাল রায়ের নাতি তথা ভাওয়াইয়া শিল্পী সুদেব রায় প্রতিমা দেবী ও মৃত্তিকার ভাওয়াইয়া গান শুনে বলেছেন এরা দুজনেই ভাওয়াইয়া গানের অহংকার। কুড়িগ্রামের নীলিফা ইয়াসমিন বলেছেন ফেসবুকে মা-মেয়ের এমন ভাওয়াইয়া গান দুই বাংলাকে একসুরে বাঁধার এক অনন্য প্রয়াস। 

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেক শব্দ সৈনিক অজিত রায়ে ছেলে রোমাঞ্চ রায় মা-মেয়ের কন্ঠের ভাওয়াইয়া গান শুনে আপ্লুত। তিনি বলেন, ‘ রংপুরের ছেলে আমি ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভাওয়াইয়ার প্রতি আমার এক দুর্বলতা আছে। বর্তমানে আমি রংপুর থেকে অনেক দুরে কলকাতায় থাকি। ফলে বাস্তবে সেভাবে সামনা সামনি ভাওয়াইয়া গানকে সেভাবে পাইনা। কিন্তু ফেসবুকে প্রতিমা দেবী ও তার মেয়ের কন্ঠের ভাওয়াইয়া গান আমায় পৌছে দেয় রংপুরে। আর আমি নিজে একজন রাজবংশী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ময় পরিবার থেকে উঠে এসেছি ফলে আরেকটি রাজবংশী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্পন্ন পরিবারের হাত ধরে আমাদের বাংলার ভাওয়াইয়া গানের চর্চা দেখে গর্ব বোধ করি। 

 

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিনবঙ্গের তথা কলকাতার অনেক মানুষও প্রতিমা দেবী ও মৃত্তিকার গানে মুগ্ধ। এমনই একজন হলেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা তথা সঙ্গীত শিল্পী ও লেখক অরিন্দম আচার্য। উল্লেখ্য, অরিন্দম বাবু পুলিশের চাকরির জন্য দীর্ঘদিন কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গে ছিলেন। সেসময় অরিন্দম বাবু বিখ্যাত ভাওয়াইয়া সঙ্গীত শিল্পী ধনেশ্বর রায়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন। শিখেছিলেন ধনেশ্বর বাবুর কছ থেকে কিছু ভাওয়াইয়া গান। আজ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলেও ফেসবুকে তিনি নজর রাখেন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া শিল্পীদের গানের প্রতি। আর তাই ফেসবুকে ভাওয়াইয়া গান ঘাটতে গিয়ে একদিন শোনেন প্রতিমা দেবী আর মৃত্তিকার গাওয়া ভাওয়াইয়া গান। শুনে খুব ভাল লাগে তার। তারপর থেকে ফেসবুকে তিনি তাদের মা-মেয়ের কন্ঠের ভাওয়াইয়া গানের নিয়মিত শ্রোতা। মেয়েকে সাথে নিয়ে মায়ের এমন সুন্দর অনুষ্ঠানকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন ‘ প্রতিটি মানুষের জীবনে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। মায়ের দেখান পথেই সন্তান পায় নতুন দিশা। তাই মেয়েকে নিয়ে প্রতিমা দেবীর এমন প্রয়াসের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান প্রতিমা দেবীকে। একইসাথে অরিন্দ আচার্যের কথা “ আমি শুনেছি প্রতিমা দেবীর স্বামী একজন পুলিস আধিকারিক। তাই এমন পুলিশ আধিকারিকের পরিবারের এমন সাংস্কৃতিক চর্চা এক বৃহত্তর পুলিশ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাকেও গর্বিত করে। আসলে পুলিশ দের পরিবারেও সংস্কৃতির চর্চা হয় তা অনেক মানুষ বুঝতে চায়না। আর প্রতিমা দেবী আর মৃত্তিকা প্রমাণ করেছে পুলিশের পরিবারেও এমন সুন্দর গানের চর্চা হয় তা। সেইসাথে মৃত্তিকার জন্যও তিনি জানিয়েছেন অনেক শুভকামনা যাতে আগামীতে মৃত্তিকা অনেক বড় শিল্পী হয়ে ওঠে। 

 

ফেসবুকে তাদের গান শুনে আপ্লুত প্রাক্তন আই পি এস অফিসার ও লেখক ডঃ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিলিগুড়িতে এডিশনাল এস পি হিসেবে থাকার সময় আমার ভাওয়াইয়া গানের সাথে পরিচিতি হয়। পরবরতী সময়ে আই এ এস অফিসার ও ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী সুখবিলাস বর্মার মুখে ভাওয়াইয়া গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়। আজ যখন দেখি উত্তরবঙ্গের এক মা তার মেয়েকে নিয়ে এই সুন্দর লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করছে সেটা এক সুস্থ সমাজ গঠনের বার্তাও বটে। এই প্রসঙ্গে ডঃ নজরুল ইসলাম বলেন, এভাবেই তো আমাদের লোকসঙ্গীত সঞ্চারিত হবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে। 

 

কোচবিহারের প্রাক্তন জেলা বিচারক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কোচবিহারে থাকাকালীণ এই ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। বর্তমানে চাকরি থেকে অবসরের পর ফেসবুকে বিভিন্ন শিল্পীর ভাওয়াইয়া গান শুনে থাকি। এরমধ্যে প্রতিমা দেবী ও তার মেয়ে মৃত্তিকার গাওয়া ভাওয়াইয়া গানও আমি শুনেছি। খুব ভাল লাগে ওনাদের ভাওয়াইয়া গান। কোচবিহার থেকে বহু দুরে থাকলেও ওনাদের মা-মেয়ের ভাওয়াইয়া গান আমায় যেন নিয়ে যায় কোচবিহারের মাটিতে।  আর প্রতিমা দেবী আর তাঁর মেয়ে মৃত্তিকা এভাবেই ফেসবুকে ভাওয়াইয়া গান শুনিয়ে মিলিয়ে দিয়েছে দুই বাংলা কে।