Image

সঙ্কটাপন্ন এলাকার দায়িত্ব নিতে হবে তরুণদের

পরিবেশ কিংবা জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম নন। এর অর্থ এই নয় যে, শব্দগুলো অনেক কঠিন ভাষায় রচিত। আসলে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় রচিত ও বহুল প্রচলিত হলেও এর অর্থ সর্বসাধারণের বুঝে ওঠা সহজ নয়। আবার সামান্য বুঝিয়ে দিলেই বিষয়টা মনে রাখতে পারেন অনেকেই। তেমনি কিছু শব্দ আছে, যেমন: জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ওজোনস্তর ও প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ইত্যাদি।

ইতোপূর্বে শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। আজকের বিষয় ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ নিয়ে। আগে জেনে নিই শব্দের অর্থ। মানুষের নানান কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাময় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা বোঝায়। সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ সংক্ষেপে ‘ইসিএ’। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন তাদের কাছে শব্দটা ব্যাপক পরিচিত।

আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরো চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে- সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ পেনিনসুলা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকাবেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে। ব্যাখ্যা দেয়া আছে- কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

প্রথমে সুন্দরবনের কথা আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসঙ্কুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। আমাদের এই জাতীয় বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে। সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠা পানির জলাশয়। এতদ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয় লোকদের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

কক্সবাজার-টেকনাফের পেনিনসুলা বন্যপ্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুইটি দ্বীপ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুটোঁ বাটানের আবাসস্থল।

অপরদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে এ দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন: পলিথিন, কোমলপানীয়ের কৌটাসহ নানান আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েশের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্টমার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়।

অপরদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক অসহনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানা নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জল বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এগুলোকে। দেশে এ ধরনের আরো কিছু সঙ্কটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে চলনবিল অন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। এখানে বলে নেয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সঙ্কটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের উপরও বর্তায়।

কারণ, এ পরিবেশটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। বলে নেয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত। সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে। আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন আর সেই উকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে ‘সবুজ আন্দোলন’। আসুন, আমরা সবুজ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করি। পাশাপাশি পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরি সবুজ আন্দোলনের মাধ্যমে। নিজের উদ্যোগে প্রচার-প্রচরণায় অংশ নিয়ে দেশটাকে সজীব করি। এ বিষয়ে কাজ করতে আমাদের যুবসম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি, ‘আপনারাই দেশের মূল শক্তি। আপনারাই পারেন সবুজ আন্দোলনকে সফল করতে। আন্তরিকতা সঙ্গে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজবিশ্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনারাও কাঁধে নিন।’

লেখক- আলম শাইন : কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ। 

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি