Image

দেশে কর্মসংস্থানে বিদেশি অনুপ্রবেশের ভয়াল থাবা

দেশে কর্মসংস্থানের জগতে হাহাকার ভয়াবহ হয়ে উঠছে। নতুন চাকরি, বেকারত্ব, শ্রমশক্তি, কর্মজীবীর সংখ্যা এসবের সুনির্দিষ্ট আপডেট তথ্য না থাকায় আড়ালে থেকে যাচ্ছে প্রকৃত ভয়াবহতা। এখন পর্যন্ত সেটা উপলব্ধি করছেন শুধু ভুক্তভোগীরা।

একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকীর্ণ। নতুন নিয়োগ নেই। আরেকদিকে গার্মেন্ট, আইটি, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সেক্টরে চলছে ছাঁটাই। এ কর্মহীনতার জের গোটা সমাজকে কোন পরিণতিতে ফেলবে বা ফেলতে পারে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতনরা।

দেশে শিক্ষার হার অনুপাতে কর্মসংস্থান নেই। কখনো ছিলও না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে ‘কর্ম খালি নেই’ মর্মে বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে রাখার সঙ্গে বাঙালি কবে থেকে পরিচিত সেটা উদ্ধার করা কঠিন। ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান আমলের ছবিগুলো দেখলে তা নতুন করে মনে হতে পারে যে কারোই। শিক্ষিতদের বড় একটি অংশকে কাজে লাগাতে পারি না।

আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। শিক্ষিত তরুণদের বিশাল বেকার থাকলে এই শিক্ষাকে মানসম্মত বা যুগোপযোগী বলা যায় না। কিছুদিন আগে, সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে তথ্য এসেছে। এতে  উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকা যায় না।

এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। তাদের জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার বলে জানানো হয়েছিল। বিবিএসের জরিপের তুলনায় বিআইডিএসের অনলাইন জরিপে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি।

বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা এই জরিপ করলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা হয়তো অসত্য বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই জরিপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন বা দ্বিমতের সুযোগ কম। বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ বাদ দিলেও দেশি-বিদেশি প্রায় সব জরিপ ও পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে।

কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ। কর্মসংস্থান এবং পারিশ্রমিকের হিসাবেও বিশাল গোলমাল। একদিকে দেশে কর্মহীনতা। দেশে কোটি কোটি বেকার লোক কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে। একই সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার দেশে-বিদেশে কাজের সন্ধান করছে। পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে ভালো চাকরি করবে এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রহর গুণছে। কিছু ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিতরা খুবই নিম্নমানের চাকরি করছে হতাশাজনক বেতনে। আরেকদিকে দেশের বাজারে উচ্চবেতনে ঢুকছে বিদেশিরা। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে রাজকীয় সম্মান-সম্মানিতে কর্মরত বিদেশির সঠিক হিসাব নেই।

সংসদে একবার এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, মোট ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করছেন। যার মধ্যে ভারতের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন। এরপরে ১৩ হাজার ২৮৬ জন চাইনিজ নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। এছাড়া জাপানি, কোরিয়ান, মালয়েশিয়ান, শ্রীলঙ্কানরা রয়েছেন। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, প্রতিবছর বিদেশিরা পাঁচশ’ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে পাঠান। এটা হচ্ছে সরকারি হিসাব।

আসল সংখ্যা সরকারের খাতায় নেই। কারণ কর্মরত বিদেশিদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে কাজ করছে। তাদের অনেকের বাংলাদেশে কাজের কোনো অনুমোদন নেই। এরা কোনো ধরনের ভ্যাট প্রদান করেন না। এখানে কাজ করে অর্জিত অর্থ চোরাপথে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের কোনো শিল্পমালিক বিদেশি লোক রাখাকে প্রেসটিজিয়াস ভাবেন। সংখ্যাটি আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে বলে দাবি বিভিন্ন মাধ্যমের। টেকনিক্যাল পার্সনের বাইরে এদেশে ভিসা নিয়ে স্কুলে শিক্ষকতার মতো পেশায়ও বিদেশি লোকজন এদেশে কর্মরত আছেন। এদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা। এই ‘বিপুল’ সংখ্যাটাও ধারণানির্ভর। বলা হচ্ছে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।

আইটি, গার্মেন্ট সেক্টরে তারা দক্ষ। কাজে এক্সপার্ট। এই যুক্তিতে অর্থাৎ আমাদের দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিশাল টাকায় পুষতে হচ্ছে বিদেশিদের। প্রথম যে রেমিট্যান্সের উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত সেটাও বাংলাদেশ থেকে নেয়া রেমিট্যান্সের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের নব্বই লাখ মানুষ বছরে রেমিট্যান্স পাঠায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর বাংলাদেশের কোটি মানুষের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এক তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছে আড়াই লাখ বিদেশি। আমাদের জনশক্তিকে দক্ষ করে এই টাকা খরচ কমানোর নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবায়নের সুখবর নেই।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভারতীয়দের চাহিদার পর্যাপ্ত কারণ ও পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। প্রথমেই যে বৈশিষ্ট্য ভারতীয় সিইওদের মধ্যে দেখা যায়, তা হলো তাদের বেশিরভাগই পশ্চিমা টপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। আবার অনেকেরই রয়েছে আইটি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো বিষয়ের সঙ্গে এমবিএর ডিগ্রির সমন্বয়। ইংরেজিতে বিশেষ পারদর্শিতার কারণে ভারতীয়দের যোগাযোগ দক্ষতা ভিন্ন মাত্রার।

বিশাল ও বহুসংস্কৃতির দেশ হিসেবে তাদের আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে বেশ দক্ষতা রয়েছে। ভারতীয়রা সহজেই পশ্চিমাদের বা অন্য সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আবার  বিরূপ পরিস্থিতিতে, স্বল্প বাজেটে কাজ করতে অভ্যস্ত ভারতীয়রা। বিশেষজ্ঞদের মতে তারা ‘বাইফোকাল এপ্রোচে’ কাজ করেন অর্থাৎ একই সঙ্গে তারা প্রতিদিনের আয় থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান। কোম্পানির লাভের দিকে তাদের থাকে সতর্ক দৃষ্টি। ব্যবসায়ের সব দিকেই তারা খেয়াল রাখেন।

ভারতীয়দের এই অভিযাত্রায় চীনারা ব্যথিত। নিজেদের অক্ষমতার কথা উঠে এসেছে এক চাইনিজ লেখকের বর্ণনায়। তার মতে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতীয়দের জটিল অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে (যেমন ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ভাষা ও ধর্ম) ভয়াবহ ব্যবস্থাপনার সংকট দেখা যায়, যার ফলে তারা ব্যবস্থাপনার দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগী হন। তারা এখন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পেশাগত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে সুফল নিচ্ছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।

সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চলেছি, যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্তে¡ও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার কেউ নেই। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

লেখক: রিন্টু আনোয়ার - সাংবাদিক  ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি