Image

সমাপনী পরীক্ষায় উপজেলা শিক্ষা অফিসের ভূমিকা

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা একটি পাবলিক পরীক্ষা। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা জাতীয়ভাবে চালু হয় ২০০৯ সালে। এর পূর্বে  নমুনায়নের ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় এ পরীক্ষা পাইলট প্রোজেক্ট হিসেবে চালু করা হয়েছিল।

পাইলট প্রোজেক্টের সফলতার কারণে ২০০৯ সাল থেকে সারাদেশে একযোগে এ পরীক্ষা চালু হয় এবং অদ্যাবধি চলমান রয়েছে। আর এ পরীক্ষাটি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর এ কারণে যে, ১০+ বয়সের শিশুরা জীবনে প্রথম একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়।

এ পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেয়া হলেও এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ সাটিফিকেটটি কোথাও দাখিল করতে হয় না। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বিশিষ্ট এই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রতি বছর যথাসময়ে প্রকাশিত হলেও এর নেই কোনো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড।

প্রতিটি জেলার উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসাররা নিরলসভাবে সফলতার সঙ্গে এ কাজটি করে যাচ্ছেন। যার প্রেক্ষিতে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের ২৯/৩০/৩১ তারিখে যথাসময়ে পিইসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে। ১১ বছর ধরে চালুকৃত এ পরীক্ষাটির সব কার্যক্রম যথাযথভাবে হচ্ছে বিধায় কর্তৃপক্ষের সবাই সন্তুষ্ট  রয়েছেন। তবে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষাটি কোনো শিক্ষা বোর্ড ছাড়াই একটি শিক্ষা অফিসকে কী রকম পরিশ্রম করে এতবড় একটি কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:

ক) পিইসি পরীক্ষাটি প্রতিবছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি/শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। খ) পরীক্ষা শুরুর পূর্বে ডি আর থেকে আরম্ভ করে প্রবেশপত্র,পরীক্ষার খাতা প্রস্তুতসহ আনুষঙ্গিক কাজ করে তা কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিতরণ করতে হয়। গ) হল সুপার, সহকারী হল সুপার নিয়োগ করা হয়। ঘ) পরীক্ষক, নিরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক নিয়োগ ও অনুমোদন করা হয়। ঙ) কক্ষ পরিদর্শক নিয়োগ করতে হয়।

চ) পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য কেন্দ্র সচিবসহ সবাইকে নিয়ে সভা করা হয়। ছ) ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র আনা ও থানা হেফাজতে শটিং করে রাখতে হয়। জ) প্রত্যেকদিন থানা থেকে প্রতিকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কেন্দ্র সচিবদের নিকট প্রশ্নপত্র হস্তান্তর করা হয়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কেন্দ্র সচিবরা পুলিশ প্রহরায় প্রশ্নপত্র নিয়ে কেন্দ্রে যান।

ঝ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পুলিশ প্রহরায় পরীক্ষা শেষে প্যাকিং করা উত্তরপত্র শিক্ষা অফিসে পৌঁছে দিয়ে যান। ঞ) উত্তরপত্র সিরিয়ালি সাজানো ও প্রতি দিনের উত্তরপত্র প্রতিদিন রোল অনুয়ায়ী গোপনীয় কোডের মাধ্যমে কোডিং করে গুছিয়ে কাটিং করা এবং মুহুরী সরিয়ে রেখে খাতা বান্ডিল করে প্যাক করা হয়। যে কাজটি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও স্পর্শকাতর কাজ।

ট) এরূপে বিষয়ওয়ারী উত্তরপত্র প্যাক করে বস্তায় ভরে ২/৩ বিষয় করে পুলিশ হেফাজতে অন্য থানায় প্রেরণ করা হয়। ঠ) বাকি পরীক্ষার খাতাগুলোও একইভাবে উপরিউক্ত কার্যক্রম করে পুলিশ ফোর্সসহ ট্রাকে করে অন্য থানায় প্রেরণ করা হয়। এক্ষেত্রে পরীক্ষার গোপনীয় কার্যক্রমে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংযুক্ত করে এসব কাজ করানোয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ঢ)  রোলের বিপরীতে গোপনীয় কোড নম্বর অনুসারে যত্নসহকারে নম্বর ফর্দ প্রস্তুত করতে হয়। তারপর অন্য থানার উত্তরপত্র গ্রহণ করে নিজ থানার পরীক্ষকদের সর্বনিম্ন ২০০/৪০০ করে উত্তরপত্র বিতরণ করা ও ৩ দিনের মধ্যে মূল্যায়ন করে নম্বর জমা দেয়া। কখনো কখনো একটি বড় হলরুমে বসেও সবাই মিলে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। ২/৩ দিন ধরে নিরীক্ষকরা ও প্রধান পরীক্ষকরা কর্তৃক যাচাই করা হয়। ণ) পরবর্তীতে থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিস ৭/৮ দিনের মধ্যে প্রত্যেক বিষয়ে নম্বর এন্ট্রি ও যাচাই করে ফলাফল তৈরি করে।

ত) পরীক্ষা গ্রহণের এ প্রক্রিয়াটি প্রতিটি উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসকে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সর্বোচ্চ এক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে করতে হয়। প্রতিটি উপজেলা/থানায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সর্বনিম্ন থেকে ২৫,০০০ বা তদূর্ধ্ব হতে পারে। থ) ফল প্রকাশ। দ) মার্কশিট দেয়া। ধ) সার্টিফিকেট লিখা ও বিতরণ। ন) সারা বছর সার্টিফিকেট সংশোধন।

প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা যদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কিন্তু এত বড় একটি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করা বা কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করা ১টি থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসের জন্য কতটুকু শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রমের বিষয় যারা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কেবল তাদের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।

আর যদি কোনো থানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জনবল ৫/৬ জন হয় তাহলে এ রকম একটি পাবলিক পরীক্ষা বিশেষ করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এই পরীক্ষাটি একটি শিক্ষা অফিসের জন্য সামলানো অনেক কষ্টকর। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে নিঃসন্দেহে। তবে এ পরীক্ষাটির কার্যক্রম একটি বোর্ডের মাধ্যমে করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আসলে এ পরীক্ষাটির সফলতা, ব্যর্থতা কিংবা ভালো-মন্দ দিক নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় বা আলোচনা করার প্রয়োজীয়তা রয়েছে তাদের, যারা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অর্থাৎ থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহঃথানা/ উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের। তাহলে এ পরীক্ষা সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব। নীতি-নির্ধারকরা আসলেই সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি যে, কতটা মানসিক, শারীরিক চাপের মুখে থেকে প্রতিটি থানা শিক্ষা অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নভেম্বর-ডিসেম্বর এই দুটি মাস মুখ বুজে এই অসাধ্য কাজটি ১১ বছর ধরে করে যাচ্ছেন।

প্রতিটি শিক্ষা অফিসকে এ সময়টাতে Do Or Die এই পণ করে এগোতে হয়। এত বিরাট একটা পরীক্ষা সুসম্পন্ন করার জন্য শিক্ষা অফিসার, সহঃশিক্ষা অফিসার ও অফিস স্টাফদের সম্মানীটাও খুবই নগণ্য। কেউ মুখ খুলে এ কঠিন বাস্তব সত্য কথাটি না বললেও প্রতিটি থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসকে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আবার পরীক্ষার এই ২ মাস সময়ে শিক্ষা অফিসকে অফিসিয়াল সব রকম দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হয়। যেমন: বিভিন্ন রকমের তথ্য আদান-প্রদান, আগামী বছরের বিনামূল্যে পাঠ্যবই গ্রহণ ও বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে বিতরণ, উপবৃত্তি কার্যক্রম ইত্যাদি। আসলে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই একমাত্র এর ভুক্তভোগী। এখানে উল্লেখ্য, প্রতিটি থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসকে প্রায় সারা বছরই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকতে হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা যায় যে, পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণের জন্য একটি প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড তৈরি করা একান্ত জরুরি, যাদের একটি সমৃদ্ধ জনবল থাকবে এবং তারাই পরীক্ষাটির বিভিন্ন কার্যক্রম ডিআর গ্রহণ থেকে আরম্ভ করে পরীক্ষা পরিচালনা, ফল প্রকাশ, পুনঃনিরীক্ষা, সার্টিফিকেট বিতরণ এবং সার্টিফিকেট সংশোধনসহ পরীক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সুসম্পন্ন করবেন। তা হলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: ফেরদৌস আরা বেগম - থানা শিক্ষা অফিসার, সেনানিবাস, ঢাকা।

মানবকণ্ঠ/টিএইচডি