Image

‌''বন্যপ্রাণির মাংসের প্রথাগত চাহিদার পরিবর্তন ঘটাতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা''

অমর ডি কস্তা, নাটোর জেলা প্রতিনিধি: আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রথাগত কিছু বৈশিষ্ট্য ও চর্চা রয়েছে যা তাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনে লালন-পালন করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এই জনগোষ্ঠী বন্যপ্রাণি শিকার করে তাদের পরিবারের জন্য মাংসের চাহিদা মেটায়। জালের ফাঁদ, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, টেটা, কুঠার ইত্যাদি দিয়ে তারা বন্যপ্রাণি শিকার করে থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় এবং পাশাপাশি শহরায়ন সহ বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ প্রণয়ন হওয়ার পর ধীরে ধীরে এই প্রথা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা। ফলে বিশেষ করে সমতল ভূমিতে বসবাসকারী দরিদ্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাগ্যে এখন আর তেমন জোটে না পশু মাংস। অপরদিকে বাজারে প্রচলিত মাংসের প্রতি তাদের আগ্রহ কম। কারণ এই সব প্রচলিত মাংস খেতে তারা অভ্যস্ত নয়। তাই পরিবারের কর্তারা তা কিনতেও যায় না। এছাড়া বাজারের বিক্রি হওয়া প্রচলিত মাংস (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া) তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তা সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে এই জাতিগোষ্ঠীর খাবারের পাত্রে মাংসের দেখা খুব একটা মেলে না। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর শিকারের তালিকা ও মাংস খাদ্যাভাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, তারা বন-জঙ্গল ও চর-বিল এলাকা থেকে খরগোশ, শেয়াল, বেজি, বনবিড়াল, খাটাশ, গুইশাপ, কচ্ছপ, বাঁদুর ইত্যাদি শিকার করে আনতো। বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এই সকল বন্যপ্রাণি শিকার, মারা, খাওয়া, কেনা-বেচা, পাচার, দখলে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।


জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক মুন্ডা কালিদাস জানান, নাটোর জেলার সকল উপজেলাতেই কমবেশী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। জেলার সমতল ভূমিতে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মুন্ডা, সাঁওতাল, উঁরাও, পাহাড়ী, মাল পাহাড়ী, মাহাতো, সিং, বাগদী, রবিদাস, তেলি, লোহার এই ১১ শ্রেণীর জাতিগোষ্ঠী। এই জেলার মোট আদিবাসী জনসংখ্যার প্রকৃত হিসাব না পাওয়া গেলেও জেলার মোট আদিবাসীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি হবে। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা এখন আর তাদের ঐতিহ্যের সাথে বহমান হচ্ছে না। সময়ের বিবর্তনে, আধুনিকায়ন বা শহরায়নের কারণে জীবনধারার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও কোন কোন ক্ষেত্রে তা খাপ খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে সংস্কৃতি চর্চা ও খাদ্যাভাস এখন তাদের ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। জীবিকায়নের ধারাও পাল্টিয়েছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর খাদ্যের তালিকায় ছিলো বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মাংস। এ সব প্রাণী তারা বন-জঙ্গল ও চর-বিল এলাকা থেকে শিকার করে আনতো এবং নিজেদের মধ্যে কেনা-বেচা করতো। মূলতঃ এসব প্রাণির মাংস সহ শামুক ও ঝিনুকের মাংস তাদের খাদ্যাভাস ছিলো। কিন্তু বর্তমানে এ সব শিকার থেকে তারা অনেকটাই দূরে রয়েছে কারণ বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন সম্পর্কে তারা অনেকটাই সচেতন। তারপরেও এগুলো শিকার যে থেমে আছে তা কিন্তু নয়। সিংড়ার কুনগ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আদিবাসী জানান, এখনও তাদের মধ্যে অনেকেই এসব প্রাণি শিকার করতে বিভিন্ন অঞ্চলে যায় এবং ফাঁদ পেতে শিকার করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বন্যপ্রাণি ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মীদের সামনে যেনো না পড়ে তার জন্য তারা সতর্ক থাকেন সর্বদা। তবে শামুক, ঝিনুক প্রকাশ্যেই শিকার করা হয় এবং এর মাংসও প্রকাশ্যেই সংগ্রহ করা হয়। জেলার বড়াইগ্রামের কুমুল্লু আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দা সলেমান বিশ্বাস জানান, শিকারের জন্য জাল ও অন্যান্য উপকরণ নিয়ে মাসে দুই একবার লালপুরের চর এলাকায় যাই। সন্ধ্যায় সেই চরে ফাঁদ পাতি এবং ভোরে গিয়ে ফাঁদে আটকে পড়া খরগোশ সংগ্রহ করে গোপনে বাড়িতে নিয়ে এসে জবাই করে পরিবার মিলে খাই। আগে এই খরগোশ বাড়ির অদুরে ক্ষেত খামারেই পাওয়া যেতো। এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। তিনি আরও জানান, আমাদের এলাকায় শেয়াল বেশ দেখা যায়। কিন্তু আইনের বাধার কারণে তা শিকার করতে ভয় পাই। তারপরেও অনেকেই শেয়ালের ফাঁদ পেতে তা শিকার করে। এসবের মাংস খাওয়ার চাহিদা ও ইচ্ছে আমাদের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মার চাহিদা। ঐতিহ্যের ধারা। তবে বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় এবং শহরায়নের কারণে এসব প্রাণির সংখ্যা নগণ্যের মধ্যে চলে এসেছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নাটোর জেলা সভাপতি নরেশ উঁরাও বলেন, আমরা দেশের আইনকে সম্মান করি। বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরপত্তা) আইন ২০১২ প্রবর্তনের পর আমরা এই বন্যপশু শিকার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং বর্তমানে কোন আদিবাসী প্রকাশ্যে বন্যপ্রাণি শিকার করে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অতি দরিদ্র এই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী কিভাবে মাংসের চাহিদা মেটাবে? বাজার থেকে পশুর মাংস বা হাঁস বা মুরগী কিনে খাবে এমন সামর্থ্য সাধারণত তাদের নাই। এই আদিবাসীরা এখনও মাংসের আশায় পশু বা পাখি শিকারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ এটা তাদের প্রথাগত সংস্কৃতি। অপরদিকে মাংস কিনে খাবার মতো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাদের নাই। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা খাদ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটির যোগান পেতে প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। যাতে এই জাতিগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা ও টেকসই উন্নয়ন ঘটে এবং আইনের ব্যতয় না ঘটিয়ে তাদের প্রথাগত এই খাদ্যের যোগান সৃষ্টি হতে পারে।


জাতীয় আদিবাসী যুব পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি যাদু কুমার রায় বলেন, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকল্পে সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ বিভিন্ন সময় গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগী বিনামূল্যে বিতরণ করছে। এ সকল গৃহপালিত প্রাণি সঠিকভাবে লালন-পালন করতে পারলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে তেমনি তাদের মাংসের চাহিদাও মিটবে। কিন্তু এখানে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তা হলো, এই সকল প্রাণিসম্পদ লালন-পালন করার জন্য আদিবাসী পল্লীগুলোতে তেমন পর্যাপ্ত জায়গা নাই। প্রাণিগুলো লালন-পালন করতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ঔষধের যোগান দিতে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও নাই। তবে এই সমস্যা উত্তোরণের পথ হলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে প্রাণিসম্পদ বিভাগের যোগাযোগ বাড়ানো, আরও কার্যকরী উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও যথাযথ মনিটরিং করা।


জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান) এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্র্তৃক সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়নকৃত এক্সপেন্ডিং সিভিক স্পেস থ্রু একটিভ সিএসও পার্টিসিপেশন এন্ড স্ট্রেন্দেন্ড গভার্নেন্স সিস্টেম ইন বাংলাদেশ প্রকল্প নাটোর জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। এই কাজে স্থানীয় পর্যায়ের সহযোগী সংস্থা হিসেবে সরাসরি কাজ করছে, বড়াইগ্রাম উপজেলায় নিডা সোসাইটি, নাটোর সদরে লাস্টার, সিংড়াতে পল্লী কল্যাণ শিক্ষা সোসাইটি (পিকেএসএস) ও বাগাতিপাড়ায় অর্পা নামক সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও)।


এ ব্যাপারে নিডা সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক জাহানারা বিউটি জানান, প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে এই প্রকল্পটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য, নাটোর জেলা ছাড়াও প্রকল্পটি রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও ঢাকা জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।


নাটোর এনজিও এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক শিবলী সাদিক বলেন, প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সরকারী সেবা প্রাপ্তি এবং জীবন-মান উন্নয়নকল্পে এক্সপেন্ডিং সিভিক স্পেস থ্রু একটিভ সিএসও পার্টিসিপেশন এন্ড স্ট্রেন্দেন্ড গভার্নেন্স সিস্টেম ইন বাংলাদেশ প্রকল্পটির গৃহিত কর্মসূচী প্রশংসনীয়। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে লক্ষিত এই বিশেষ জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে এবং মর্যাদা নিয়ে একিভূত সমাজ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ ও বসবাসের সুযোগ লাভ করবে।


জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সেলিম উদ্দিন জানান, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত চাহিদা বন্যপ্রাণির মাংস এটা জানি। আবার এটাও জানি বন্যপ্রাণি নিধন দেশের প্রচলিত আইন পরিপন্থী কাজ। এই জনগোষ্ঠীর এই প্রথাগত মাংসের চাহিদা মেটাতে বিকল্প ও আইন সম্মত উদ্যোগ নেওয়া জরুরী। কারণ মৌলিক অধিকার খাদ্যের তালিকায় মাংস থাকাটা এই নাগরিকদের অধিকার বটে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন বা সংবাদ পৌঁছালে বিশ্বাস করি সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুরুত্বের সাথে এ বিষয়ে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
#