Image

দরদি কবি আহসান হাবীব

১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে কবি আহসান হাবীব জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মাতা জমিলা খাতুন। তার পাঁচ ভাই ও চার বোন।

১৯৩৫ সালে তিনি পিরোজপুর জেলা থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। তারপর অর্থাভাব চরমভাবে দেখা দেয়। কিছুদিন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে আইএ ক্লাসে অধ্যয়নরত অবস্থায় কবিকে কলেজ ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে অর্থের কশাঘাত সইতে না পেরে, অসচ্ছলতা দূর করার জন্য তিনি লেখাপড়া ছেড়ে কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অর্থের অভাব কী? তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। তারপর তিনি আজীবন ওই পেশাতেই নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি কলকাতায় ‘তকবীর,’ ‘বুলবুল’ ও ‘সওগাত’ পত্রিকায় কাজ করেছেন। কয়েক বছর তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।

১৯৫০ সালের দিকে দেশভাগের পর তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসে বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ (বর্তমানে ধারণা করা হয় ইত্তেফাক) প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৬৪-এর দিকে তিনি দৈনিক বাংলা (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান) পত্রিকায় জীবনের শেষবেলা পর্যন্ত সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে জীবিকা অর্জনের পথ বেছে নেন। ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়ার সুফিয়া খাতুনকে আহসান হাবীব বিয়ে করেন। তার চার সন্তান। পুত্র মঈনুল আহসান সাবের, মনজুরুল আহসান জাবের, কন্যা কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন।

তিনি আধুনিকমনস্ক, চেতনাশীল, কাব্য, ভাষাজ্ঞান ও তার পথ ধরে কবিতায় অনন্ত দর্শন ও মননে ছিল অসাধারণ প্রতিভা এবং পথপ্রদর্শক, পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শনের চৈতন্যতা, জীবনঘনিষ্ঠতা, মানবিক বেদনাবোধ, জীবনবোধ, প্রেমের মূল্যবোধ, সততা, ন্যায় নিষ্ঠা, শিষ্টাচার, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সৃজনশীলতা, মাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ, নৈতিকতায় কাব্যনির্মাণে আহসান হাবীবের কোনো জুড়ি নেই। তিনি আধুনিক কাব্যধারার কবি ছিলেন। কবির ছেলেবেলা থেকেই কাব্যচর্চা ও কাব্যরস সোপানে অবিচল রচনাশৈলী তৈরি করে গেছেন।

১৯৩৩ সালে তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন তখন স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম লেখা একটি প্রবন্ধ ‘ধর্ম’ প্রকাশিত হয়। পরের বছর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ ছাপা হয় পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন তিনি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এভাবেই কবি আহসান হাবীবের সাহিত্যিক কবির চাকা ঘুরতে থাকে। পরে দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রাসহ নানা পত্রিকায় আহসান হাবীবের কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৯৪৭ সালে প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয়। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়াহরিণ’ ‘সারা দুপুর’ ‘আশায় বসতি’ ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ ‘দুহাতে দু আদিম পাথর’ ‘প্রেমের কবিতা’ ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ ইতাদি। তার দুটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো ‘অরণ্য নীলিমা’ ও ‘রাণীখালের সাঁকো’। এ ছাড়া শিশুতোষ গ্রন্থ; জ্যোৎস্না রাতের গল্প, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, ছুটির দিন দুপুরে ইত্যাদি। এই মানবদরদির কবিতা এখনো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্য বইয়ে স্থান করে আছে। তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে গণ্য। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভ‚ষিত করে। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় কবি আহসান হাবীব পাঠক মহল ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।

লেখক-মোহাম্মদ মহসীন : প্রকৃতিবিষয়ক ও প্রাবন্ধিক

মানবকণ্ঠ/এইচকে