Image

আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীন

রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথে কোথায় চলে যাও?
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশে ছড়িয়ে পড়া আবির রঙে নাওয়া
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা-
সেথায় যাব ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।

সহজ-সরল গ্রামবাংলার এমন অসাধারণ রূপ যার কবিতায় ফুটে ওঠে তিনি আমাদের সবার প্রিয়, আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা। ১৯০৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নিজের নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জসীমউদ্দীনের পিতা মৌলভী আনসার উদ্দিন মোল্লা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কবির মা মোসাম্মৎ আমেনা খাতুন ছিলেন নকশি পিঠা এবং নক্সীকাঁথা সেলাইয়ে বিশেষ পারদর্শী। গ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা জসীমউদ্দীন পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন শোভারামপুর অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায়। এরপর হিতৈষী বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেন। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন ফরিদপুর জিলা স্কুলে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় জসীমউদ্দীন দেশজুড়ে চলা অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে স্বদেশি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি ১৯২১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলছাত্র জসীমউদ্দীন গড়ে তোলেন ‘মুসলিম ছাত্র সমিতি’ যার মাধ্যমে তিনি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করার চেষ্টা করতেন।

জসীমউদ্দীন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আই.এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে কবির সাহিত্য জগতে বিচরণ শুরু হয়। মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার ‘মিলন-গান’ নামক কবিতা প্রকাশিত হয়, যা ছিল তার প্রথম রচনা। কলেজে থাকাকালে তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’ যা তৎকালীন সাহিত্য পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়েছিল। কবর কবিতার বিষয়বস্তু এবং লেখার মান এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, কবিতাটি সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়, যা তাকে বিরল খ্যাতি এনে দেয়।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তার লেখার মাধুর্য দিয়ে বাংলার পল্লী জীবনকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশ করেছেন। তার লেখায় গ্রাম-বাংলার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম বিষয়টিও এক অসাধারণ রূপ পেয়েছে। ছোটদের জন্য লেখা ‘আমার বাড়ি’ কবিতাটির শেষ অংশে কবি লিখেছেন-

‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর
এই বরাবর পথ,
মৌরি ফুলের গন্ধ শুঁকে
থামিও তব রথ।’

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ রচনা তার কাহিনীকাব্য নক্সীকাঁথার মাঠ এবং সোজন বাদিয়ার ঘাট। রাখালী, বালুচর, ধানক্ষেত তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ছোটদের জন্য লিখেছেন হাসু, ডালিমকুমার, এক পয়সার বাঁশির মতো অসাধারণ সব বই। যে দেশে মানুষ বড়, চলে মুসাফির, হলদে পরীর দেশে তার লেখা ভ্রমণকাহিনী। লিখেছেন পদ্মাপার, বেদের মেয়ে, পল্লীবধূ, গ্রামের মায়া ইত্যাদি নাটক ও কাহিনী কাব্য। পল্লী সাহিত্য সংরক্ষণ এবং প্রসারের কাজে নিজেকে আজীবন নিয়োজিত রেখেছিলেন। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে তিনি একজন পল্লীগীতি সংগ্রহ হিসেবে কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন তিনি। ১৯৭৬-এর ১৪ মার্চ ঢাকাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি জসীমউদ্দীন। ১৯৭৮ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে।

মানবকণ্ঠ/এইচকে