Image

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন কবি, রাজনীতিবিদ। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর, ১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। পিতা ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন আবগারি বিভাগের প্রসিকিউটর। মাতা যামিনী দেবী। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভবানীপুর মিত্র স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৭), স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ (১৯৩৯) পাস করেন। এ সময় তিনি কবি সমর সেনের সান্নিধ্যে মার্কসীয় রাজনীতি ও লেবার পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

১৯৪০ সালে তার পদাতিক (১৯৪০) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে তিনি শ্রমজীবী জনসাধারণের মুক্তিপ্রয়াসী কবি হিসেবে বাংলা কবিতাঙ্গনে পরিচিত হন। ১৯৪১ সালে বিএ পাস করে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৪২ সালে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি আব্দুর রাজ্জাক, সতীশ পাকড়াশী, পারভেজ শহীদি, চারু মজুমদার, গিরিজা মুখার্জী, চিšে§াহন সেহানবীশ প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে বন্দী হন।

১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পেলে একটি প্রকাশনা সংস্থায় তিনি সাব এডিটর হিসেবে নিযুক্ত হন। এ বছরই তার চিরকুট (১৯৫০) কাব্য প্রকাশিত হলে তিনি মার্কসীয় বস্তুবাদী ধারার কবিরূপে খ্যাতি লাভ করেন। পরের বছর (১৯৫১) তিনি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কেবল কবি নন, গদ্য লেখক হিসেবেও ছিলেন শক্তিমান। আমার বাংলা (১৯৫১), অক্ষরে অক্ষরে (১৯৫৪), কথার কথা (১৯৫৫) প্রভৃতি গদ্য রচনায় পাওয়া যায় তার মনস্বিতার পরিচয়। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাংগঠনিক নেতৃত্বে পারদর্শিতার পরিচয় দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি তাসখন্দে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের প্রতিটি পর্বে লক্ষ করা যায় মানবীয় বোধের উদ্বোধন। তিনি তার সাহিত্য-সাধনায় মানুষের অসীম সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। এজন্য বলা হয়েছে সুভাষের সাহিত্য-সাধনা ছিল তার জীবন-সাধনার অপর নাম।

সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সবকিছুর কেন্দ্রে তিনি মানুষকে স্থাপন করে জীবনের সদর্থক দিকের উন্মোচন করেন। এ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তার কবিতাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে। কবিতাকে তিনি শ্রমশীল, উৎপাদনক্ষম মানুষের উজ্জীবনের মন্ত্র হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে তিনি সাহিত্যিক রূপদানে আগ্রহী ছিলেন। ফলে শিল্পী হিসেবে তিনি ‘অৎঃং ভড়ৎ অৎঃং ঝধশব’ -এ বিশ্বাস করতেন না। তাই তার কবিতায় কবি ও কর্মীর মেলবন্ধন ঘটতে দেখা যায়। তিনি কবিতায় দুর্বদ্ধতা সর্বদা পরিহার করার চেষ্টা করেন। কেননা তার লক্ষ্য ছিল জনসাধারণের চেতনাকে জাগ্রত ও শাণিত করা। সে লক্ষ্যে তিনি সমাজের সর্বস্তরে তার কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তাছাড়া সারল্য কবিতার একটি প্রধান গুণ হিসেবে তিনি বিবেচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের কবিকে সুবোধ্য হতে হয়। ফলে সমাজমনস্কতা এবং রাজনীতি-চেতনার স্বার্থেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের ছবি চিত্রিত হয়েছে।

তার অন্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ফুল ফুটুক (১৯৫৭), যত দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬), এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২) ও ধর্মের কল (১৯৯১) প্রধান। গদ্যগ্রন্থ- ক্ষমা নেই (১৯৭২), খোলা হাতে খোলা মনে (১৯৮৭) প্রভৃতি। আত্মজীবনী আমাদের সবার আপন ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন (১৯৮৭), ঢোলগোবিন্দের মনে ছিল এই (১৯৯৪)। উপন্যাস- হাংরাস (১৯৭২), কে কোথায় যায় (১৯৭৬), কাঁচা-পাকা (১৯৮৯)। কমরেড, কথা কও (১৯৯০) গ্রন্থ প্রকাশের আগে (১৯৮১) কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ থেকে তিনি অব্যাহতি নেন। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই তার মৃত্যু হয়।

মানবকণ্ঠ/এইচকে